ডঃ শ্রাবনী চ্যাটার্জি
বর্ষায় সহ্যাদ্রি সত্যিই সুন্দর। কী যে তার রূপ তখন সে যে না দেখেছে তাকে বলে বোঝানো মুশকিল। একে আমরা বাঙালিরা পাহাড় বললেই সটান হিমালয় পাড়ি দিই। অন্য কোনও পাহাড়কে হিসেবের মধ্যেই ধরি না। আমিও সেই দলেই ছিলাম। সবেমাত্র দু’টি বছর হল বৃষ্টিভেজা সহ্যাদ্রিকে দেখেছি আর দেখে তার প্রেমেও পড়েছি।
ট্রয় ট্রেনে যেতে হয় মাথেরান।
এমনিতে সারা বছর সহ্যাদ্রি খুবই ম্যাড়ম্যাড়ে। রস-কষ তার পড়তির দিকে। আমার তো তাকে দেখে কেমন যেন গেরস্ত বাড়ির গিন্নির মতো লাগে। বয়স মাঝের দিকে (হিমালয়কে নবীনা ধরলে ইনি প্রৌঢ়া), চেহারা আঁটোসাটো কেজো ধরণের। রূপের যত্ন বলতে নেই। চারটি হলদেটে ঘাস আর আধ শুকনো গাছপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন হামেশাই ব্যস্ত হয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না। বর্ষা যেই এল অমনি ইনি সাজতে বসলেন। গায়ে কচি ঘাসের শাড়ি পরলেন, রংবেরঙের ফুলের গয়নায় সাজালেন নিজেকে। আর পশ্চিম সমুদ্র থেকে এনে জড়ালেন মায়া মেঘের উড়নি। পরিপাটি সাজে তখন তার কী শ্রী! নাই বা থাকুক হিমালয়ের লাবণ্য কিন্তু সেজেগুজে এঁকে দেখেও তাক লেগে যায়।
পাহাড় চুড়োয় আটকে থাকা মেঘের মেখলা।
আমি সহ্যাদ্রিকে সেই মোহময়ী রূপে প্রথম দেখেছি গত বছর, মাথেরানে। সেপ্টেম্বরের প্রথমেই ভরা বর্ষায় এক শনিবার মুম্বই থেকে রওনা দিলাম। মাথেরান যাওয়ার সব থেকে শস্তায় পুষ্টিকর উপায় হল দাদর স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেন ধরে নেরাল যাওয়া। নেরাল থেকে আগে টয় ট্রেন চলত মাথেরান যাওয়ার। এখন আর চলে না। স্টেশনের বাইরে শেয়ারের গাড়ি চড়ে ‘ঘাট’ এ উঠতে হয়। আমান লজ অবধিই গাড়ির মেয়াদ। তার পর আর গাড়ি চলে না। মাথেরান হল এই মহাদেশের অন্যতম ‘অটোমোবাইল ফ্রি জোন’। জ্বালানির গাড়ি নিষিদ্ধ।
বর্ষায় সহ্যাদ্রি সাজতে থাকে এমন ভাবেই।
আমান লজ থেকে টয় ট্রেন যায় মাথেরান অবধি। সেটা ছাড়াও টানা রিকশা আছে, ঘোড়া আছে। আর সব থেকে বড় জিনিস আছে ‘পা-গাড়ি’। ডাইনে বাঁয়ে সহ্যাদ্রির কুয়াশা ঘেরা উপত্যকার সৌন্দর্য, ঝিরঝিরে পাহাড়ি ঝর্না আর নিস্তব্ধ অরণ্যানি উপভোগ করতে করতে ওইটুকু রাস্তা কখন যেন পেরিয়ে যায়।
সফরের সময়ের আশ্রয়।
মাথেরানে ভিড়ভাট্টা বিশেষ নেই। শনি ও রবিবার কিছু মানুষ আসেন বর্ষা প্রকৃতির টানে। সপ্তাহের মাঝে গেলে তো নিস্তব্ধতাই সঙ্গী। তবে থাকার-খাবার অসুবিধে নেই। মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের গেস্টহাউস-সহ বহু বিলাসবহুল রিসর্ট হোটেল আছে ওখানে। আবার সাধারণের সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণের উপায়ও আছে। দেখার মধ্যে আছে উপত্যকাকে মন ভরে দেখে নেওয়ার জন্য ইকো পয়েন্ট, লর্ডস পয়েন্ট, আলেকজান্ডার পয়েন্ট ইত্যাদি। আছে পিসারনাথ শিবের মন্দির আর শার্লট লেক। জনপ্রিয় আহামরি পর্যটন কেন্দ্র কোনওটাই নয়।
ফুলের আঁচল বিছিয়ে আহ্বান।
তবে বাদল দিনের অঝোর ধারায় ভিজতে থাকা সবুজ পাহাড়, কুয়াশার চাদরে মোড়া রহস্যময় বন আর আপনজনের সঙ্গে একটু একান্তবাস চাইলে দু’দিনের জন্য ঘুরে আসাই যায় এই শৈলশহরে।
ছবি— লেখিকা
(চলবে)