ডঃ শ্রাবনী চ্যাটার্জি
ভেজা বাতাস যেই পশ্চিম সমুদ্র থেকে বর্ষার আগমনবার্তা বয়ে আনে অমনি মন ময়ূরের মতো নেচে ওঠে। ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গলে একঘেয়ে ধারাবর্ষণের মাঝে সহ্যাদ্রি যখন ছুটির চিঠি পাঠায় তখন তার ডাকে সাড়া না দেওয়ার আর উপায় থাকে না। তাই কর্তা-গিন্নি আবার এক ভোরে বেরিয়ে পড়ি। এবারের গন্তব্য পঞ্চগনি।
ভিজতে ভিজতে এক অনন্য সফর।
ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন আবাস পঞ্চগনি বিখ্যাত হল তার টেবল ল্যান্ডের জন্য। মুম্বই থেকে যদিও দূরত্ব ২৫০ কিমি তবে কুছ পরোয়া নেহি। যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। অন্ধেরির বিসলেরি কম্পাউন্ড থেকে প্রচুর ট্র্যাভেল এজেন্সির বাস যায় পঞ্চগনি। ‘এসি সিটার’ আর ‘স্লিপার কোচ’ দু’রকমই পাওয়া যায়। তার মধ্যে যে কোনও একটায় চেপে বসলেই ঘণ্টা ৬-৭ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছনো যাবে পঞ্চগনি। আর সেই যাত্রাপথ, আহা তার কথা কী আর বলি!
যাত্রাপথে এমন দৃশ্য মুগ্ধ করবেই।
নবি মুম্বই ছাড়ালেই পশ্চিমঘাট যাকে বলে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু বেয়ে, অজস্র টানেল কাটিয়ে সেই রাস্তা ছুটে চলে লোনাভালা, পুণে হয়ে ওয়াইয়ের দিকে। যাত্রাপথের এমন নয়নাভিরাম রূপ খুব কম দেখেছি। সেখানে কোথাও পাহাড়ের মাথায় মেঘের সারি, কোথাও দূরে ঝিরঝিরে ঝরনা, কোথাও গহন মেঘের শ্যামল ছায়া আর কোথাও বা রিমঝিম ঘনঘন বরিষণ। দেখতে দেখতে কখন যে পঞ্চগনি পৌঁছে যাবেন টেরও পাবেন না। মাঝে এক উদুপি রেস্তরাঁ আর ওয়াইয়ে জলযোগ বিরতি।
সিডনি পয়েন্টের সেই সাঁকো।
ভাল কথা, ওয়াইয়ের কিন্তু একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আফজল খান যখন ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে ‘পার্বত্য মূষিক’ শিবাজীকে প্রতাপগড়ে অবরুদ্ধ করতে আসেন তখন ওয়াইতেই তাঁর সেনাছাউনি পড়েছিল। সে যাত্রায় আফজাল খানের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ওই যে একটা গান আছে না, ‘সফর খুবসুরত হ্যায় মঞ্জিল সে ভি’।
এখানে মেঘ-উপত্যকা লুকোচুরি খেলে।
পঞ্চগনিতে গণপরিবহণ বলতে গাড়ি। ব্রিটিশ মেজাজ তার পুরো দস্তুর বজায় আছে। বাস থেকে নেমে অমনি এক গাড়ি নিয়ে পৌঁছলাম আমাদের ডেরায়। গাছপালায় ঘেরা সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট কটেজ শান্তিবন। সেখানে একটু বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়া সেরে বেরোলাম পঞ্চগনির এদিক সেদিক দেখতে। এ ক্ষেত্রেও সেই গাড়িই ভরসা। গাড়িচালকদের সঙ্গে একটু দামাদামি করে মনমতন প্যাকেজ নিয়ে নেওয়া যায়। পঞ্চগনির মূল আকর্ষণ টেবল ল্যান্ড হলেও আরও কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। বর্ষা ভেজা পাহাড়ের রূপ দেখতে চাইলে পারসি পয়েন্ট বা সিডনি পয়েন্টে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানোই যায়। সিডনি পয়েন্টে পাহাড়ের উপর কাঠের ছোট্ট সাঁকো। তার উপর দাঁড়িয়ে এলোমেলো হাওয়ার মাতন ভারী উপভোগ্য।
ছবির মতো শৈলশহর।
আর আছে ধারী মাতার মন্দিরও। তবে যেখানেই যান না কেন হাতে একখানা বড় ছাতা রাখতেই হবে। নইলে দামাল মেঘ দুষ্টুমি করে হঠাৎ ছুটে এসে কখন আপনাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে বুঝতে পারবেন না। আরেকটা জিনিসের জন্যও পঞ্চগনি খুব বিখ্যাত। সে হোল এখানকার বোর্ডিং স্কুল। অনেক নামী-দামি বোর্ডিং স্কুল রয়েছে এখানে। যেখানে বলিউডের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরই হাতে খড়ি হয়েছে। ‘তারে জমিন পর’ সিনেমার সেই স্কুলও কিন্তু পঞ্চগনিতেই।
বর্ষার প্রকৃতি।
আর রয়েছে মাপ্রো গার্ডেন। পঞ্চগনি থেকে একটু দূরেই বিরাট এলাকা জুড়ে মাপ্রা সংস্থার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শাখা। সেখানে চারিদিক ভারী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুন্দর করে সাজানো। খিদে পেলে এদেরই রেস্তরাঁয় দুর্দান্ত ক্লাব স্যান্ডউইচ বা পিৎজা খাওয়া যায়। আর আছে এদের তৈরি নানারকম জ্যাম, জেলি, ফলের রস, চকলেট, লজেন্স ইত্যাদির সম্ভার। এরা বিনামূল্যে সে সব চাখতে দেয়। ভাল লাগলে কিনে নেওয়াও যায়।
এই সেই টেবল ল্যান্ড।
এ সব দেখা সেরে যাওয়া যায় এখানকার টেবল ল্যান্ডে। দাক্ষিণাত্য মালভূমি এখানে দু’বাহু বিছিয়ে রেখেছে বিরাট বিচরণ ক্ষেত্রের আকারে। প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার বিস্তৃত সেই জায়গায় ডেভিল’স কিচেন-সহ আরও কিছু দ্রষ্টব্য আছে। সে সব ঘুরতে ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি নেওয়াই যায়। আবার হাতে অগাধ সময় আর মনে অপার মুগ্ধতা থাকলে হেঁটেও ঘোরা যায়। তার পর কোনও এক পাথরের উপর বসে একটু জিরোবার ফাঁকে গুনগুন গান বা নির্ভেজাল আড্ডা। টেবল ল্যান্ড ঘুরে নীচে নামার সময় হরেকরকম দোকানের পসরা। খাবারদাবার থেকে শুরু করে নানান জিনিসের বিকিকিনি। সেখানে একটু থেমে কান্দাভাজি আর গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে নজর পড়ে, বাইরে আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামছে।
মাপ্রো গার্ডেনে।
তিমির অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ছে সহ্যাদ্রির মুখ।
ছবি— লেখিকা
(চলবে)