ফারুক আব্দুল্লাহ
বেশ কয়েকবার নানান কাজে কান্দি গিয়েছি। তখন মাঝেমধ্যে রাজবাড়ি চত্বরে গেলেও ভেতরে প্রবেশের সৌভাগ্য হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম রাজবাড়ির কোনও সদস্যই নাকি এখন আর এই বাড়িতে থাকেন না। রাজবাড়িটি এখন প্রায় ভাড়াবাড়িতে পরিণত। বেশ কয়েকটি পরিবার ভাড়া থাকেন। তবে রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশের একটা সুপ্ত ইচ্ছে সব সময়ই মনের মধ্যে বিরাজ করত। ইচ্ছে পূরণের উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না এতদিন। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেপূরণ হয় মিঠুদির সহযোগিতায়।
মিঠুদি কান্দি রাজ কলেজের অধ্যাপিকা এবং জেলার এক শিক্ষক সংগঠনের লড়াকু নেত্রীও। দিদির সঙ্গে আমার আলাপ হয় ২০২০ সালে। তার পর অজস্রবার দেখা হয়েছে। এই স্বার্থপরতার যুগে মিঠুদির মতো অন্তরিক এবং সব সময় মানুষের বিপদেআপদে পাশে দাঁড়াবার মতো মানসিকতার সত্যিই অভাব। কোভিড-কালে মিঠুদির মহানুভবতার অনেক নিদর্শনও দেখেছি।
রাস্তায় ছড়িয়ে এমন রাজ নিদর্শন।
দিদির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়ে একদিন কান্দি রাজবাড়ির প্রসঙ্গ এল। দিদিকে বলেছিলাম, ‘‘কান্দি শহরে তোমার তো অনেক চেনা জানা। আমাকে একদিন রাজবাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে পারবে?’’ দিদি ছুটির দিন দেখে কান্দি আসতে বলেছিল। যাতে অনেকটা সময় নিয়ে ঘোরা যায়। তীব্র ইচ্ছা থাকলেও নানান কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দিদি বেশ বিরক্তও হয়েছে। যাব বলে কথা দিয়েও নানান কারণে বহুদিনই যেতে পারিনি। তবে এবার আর তেমনটা হয়নি। ভরদুপুরে হাজির হয়েছিলাম কান্দিতে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজবাড়ি যাওয়ার টোটো ধরে দিদিকে ফোন করি। দিদি রাজবাড়ি যাওয়ার টোটোতে উঠেছি শুনে বলে ‘‘রাজবাড়ি না, তুই টোটোকে বল কলকাতা মার্টে নামতে।’’ সেখানে নেমে ফোন করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দিদি হাজির। দিদি বলল, ‘‘এই ভর দুপুরে তুই রাজবাড়ি যাবি? এখন আমাদের বাড়ি চল। ৩টের সময় রাজবাড়ি যাব। ওদের বলে রেখেছি।’’
রাজবাড়ি। সামনে থেকে।
দিদিদের বাড়ি একেবারে কান্দি শহরের প্রাণকেন্দ্রে, বাজারের মধ্যে। পুরনো আমলের সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা এগোতেই বাড়িতে প্রবেশ করলাম। ঘিঞ্জি শহরের মধ্যে এমন মনোরম বাড়ি দেখে মুগ্ধ হলাম। প্রথমে সিঁড়ি পার করেই একটি বড় বারান্দা। আর বাড়ির চারিদিকে আরও অনেক বাড়ি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাকিমার সঙ্গে পরিচয় হল। অনেক গল্পও হল। পুরনো দিনের অনেক কথা উঠে এল। মিঠুদিদের বাড়ির অনেক ইতিহাস। মিঠুদি জানায়, তাদের বাড়িটি নাকি প্রায় ৭০-৭৫ বছর বা তারও আগে হোটেল হিসেবে গড়ে উঠেছিল। হোটেলটি খুলেছিলেন শান্তি ঘোষাল নামে এক মহিলা। হোটেলের নাম ছিল ‘ঘোষাল হোটেল’। সেখানে নাকি কাঁসার বাসনে ঘরোয়া ভাবে খাবার পরিবেশন করা হতো। বাড়ির নীচের খোলা চত্বরেই এক সময় বাংলার কিছু নামী সংস্থার থিয়েটারের নিয়মিত মহলা হত।
হর্ম্য মাঝে খোলা আকাশ।
নানান কথায় ঘণ্টা খানেক পার হয়েছে। কাকিমা দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য বলতে শুরু করেছে। মিঠুদি নিজের হাতে নানান সব লোভনীয় পদ রান্না করেছে ভাইকে খাওয়াবে বলে। খাওয়াদাওয়ার পরে আরও ঘণ্টাখানেক আড্ডা। আমরা যখন রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোলাম তখন দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল শুরু হয়েছে। দিদি রাজবাড়ি যাওয়ার একটি সহজ অলিগলি পথ ধরে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকল। মিঠুদির জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই কান্দি শহরেই। তাই শহরের সব পথঘাট তার নখদর্পণে। এলাকায় মিঠুদির জনপ্রিয়তা দেখেও মুগ্ধ হতে হল। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা দেখে মিঠুদিকে মনে হচ্ছিল যেন কান্দি রাজবাড়ির কোনও রানি। মিঠুদির বাড়িতে নানান কথা প্রসঙ্গে পাইকপাড়া রাজবাড়ির কথা উঠলে দিদি বলেছিল, ‘‘ওটাও তো আমাদেরই।’’ এই কথাটাই প্রমাণ করে রাজবাড়ির সঙ্গে দিদির আত্মার যোগাযোগ।
বহু অর্থ ব্যয়ে লম্বা বারান্দা।
কিছুটা পথ পেরিয়ে রাজবাড়ি চত্বরে জরাজীর্ণ খিলান যুক্ত প্রবেশপথ পার করলাম। সামনেই বড় পুকুর। দিদি জানাল, এটা নাকি ‘নাচ পুকুর’। এমন নামকরণের কারণ অবশ্য দিদিরও জানা নেই। এই পুকুরের সামনেই রাজবাড়ি। রাজবাড়ির সামনে সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠ। আমরা পুকুরের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশের জন্য দিদি তার এক সহকর্মী তনুশ্রীদিকে বলে রেখেছিল। তনুশ্রীদিও মিঠুদির কলেজেই অধ্যাপনা করেন। তনুশ্রীদির বাড়ি রাজবাড়ির একেবারেই লাগোয়া। রাজবাড়ির জমি কিনে দিদিরা সেখানে বাড়ি করেছেন। তনুশ্রীদির জন্য আমরা রাজবাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। রাজবাড়ির ফাঁকা মাঠে তখন কচিকাঁচারা ক্রিকেট খেলছে। মিঠুদি তাদের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করল। আর এই ফাঁকে আমি রাজবাড়ির বাইরের দিকের বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললাম। তনুশ্রীদি আসার আগে রাজবাড়ির ইতিহাসটা একবার দেখে নিই।
আমার সহায়েরা।
‘উত্তররাঢ়ী কায়স্থ-কারিকা’ অনুসারে বনমালী সিংহ অনুমানিক ১২-১৩ শতকে বন কেটে কান্দির পত্তন করেন। নবাব আলিবর্দী খানের সময়ে কান্দি রাজ বংশের রাধাকান্ত সিংহ রেশমের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় তিনি ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন। তবে রাধাকান্ত সিংহ সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। কান্দি রাজবংশের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় রাধাকান্ত সিংহের পুত্র হরেকৃষ্ণ সিংহের আমল থেকে। কথিত, হরেকৃষ্ণ সিংহের পুত্র গৌরাঙ্গ সিংহ কান্দি রাজবাড়ি ও রাধাবল্লভের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
ঘরের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে কোনও রাজার ছবি।
কান্দি রাজ বংশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। ওয়ারেন হেস্টিংসের সুপারিশে তিনি রেজা খাঁর অধীনে কানুনগো পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তাঁর ঠাটবাটের প্রমাণ মেলে মাতৃশ্রাদ্ধের সময়। কথিত, তিনি মাতৃশ্রদ্ধে নাকি প্রায় ২০ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। নিমন্ত্রিত সাহেব ও রাজাদের জন্য কান্দিতে বড় বড় বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। অতিথি আপ্যায়নের জন্য বড় বড় পুকুর কাটিয়ে সেখানে দুধ, দই, তেল, মধু, ঘি রেখেছিলেন। দেওয়ানজির মাতৃশ্রাদ্ধে বর্ধমানের মহারানি নাকি প্রায় ১০-১২টি নৌকা ভর্তি মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে সেগুলো কান্দিতে পৌঁছতে না পারায় নষ্ট হয়ে যায়।
গঙ্গাগোবিন্দের পৌত্র লালাবাবুও (কৃষ্ণকান্ত সিংহ) এই বংশের একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। লালাবাবুর অন্নপ্রাশনেও নাকি সোনার পাতে নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করা হয়েছিল।
ছবি তুলতে সাহায্? করছে মিঠুদি।
বর্তমান রাজবাড়িটি কে নির্মাণ করেছিলেন সেই বিষয়ে তেমন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি কোথাও। অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। রাজবাড়ির নির্মাতা হিসেবে গৌরাঙ্গ সিংহের নাম বলা হয়ে থাকে। তবে তাঁর নির্মিত রাজবাড়ির আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। খুব সম্ভবত ১৯২৩ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করতে একবার কান্দি শহরে এসেছিলেন। তিনি তাঁর এক লেখায় সেই অভিজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বহু বছর পর কান্দি শহরে এসে দেখছেন শহরের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তিনি লিখছেন, ‘আগে রাধাবল্লভের বাড়ির চারিদিকেই শহর ছিল। এখন আদালতের চারিদিকে শহর হইয়াছে-আগে যেখানে মাঠ ধান বন ছিল এখন সেখানে কোটাবাড়ি হইয়াছে, আর যেখানে অনেক কোটাবাড়ি ছিল সেখানটায় কোটাবাড়ি আছে কিন্তু বড় বেমেরামত আছে। পুকুরগুলি প্রায় দামে ঢাকিয়া গিয়াছে। রাধাবল্লভের নহবৎখানা পড়িয়া গিয়াছে। রাজাদের যে প্রকাণ্ড বাড়ি ছিল তাহা পড়িয়া গিয়াছে-খানিক’। এখন প্রশ্ন হল, ১৯২৩ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে রাজবাড়ি দেখেছিলেন যার কিছুটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেই বাড়িটিই কি মেরামত করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছে? নাকি বাংলা ১৩৪৯ সালেই নতুন করে নতুন কোনও স্থানে বর্তমান সময়ের এই রাজবাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে? এই বিষয়েও সঠিক কোনও তথ্য মেলেনি।
রাজবাড়িতে এখন সাধারণের বাস। তারই চিহ্ন।
এর মধ্যেই তনুশ্রীদি এসে পড়েছেন। তিনি এবার আমাদের নিয়ে এগিয়ে চললেন রাজবাড়ির দিকে। রাজবাড়ির মাথার ঠিক মধ্যেখানে চোখ পড়তেই দেখা গেল সেখানে লেখা রয়েছে, ‘শ্রীরাধাবল্লভ জয়েতি, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ’। এবার আমরা মাঠ পার করে রাজবাড়ির নীচের বারান্দায় প্রবেশ করি। খুব ভাল লাগছিল সেখানে। এর আগে কয়েকবার রাজবাড়ি এলেও এই নীচের বারান্দা পর্যন্তও কখনও আসা হয়নি। এবার বারান্দা পার করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বাড়ির মধ্যেখানে খোলা বাঁধানো আঙ্গিনা। যার চারপাশে পিলার যুক্ত লম্বা বারান্দা। বারান্দার পাশে সারি দেওয়া ঘর। উঠোনে নানান আকারের টবে নানা জাতের ফুল গাছ। রাজবাড়ির দোতলার বারান্দায় তীর বর্গায় প্রচুর পায়রা বসে আছে। যারা ইচ্ছে মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।
আমরা প্রথমে আঙিনায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে চারিদিকের ছবি তুলতেই দেখি, রাজবাড়ির নীচের তলায় বসবাসকারী (খুব সম্ভবত রাজবাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন তিনি) এক ভদ্রলোক দোতলাটি আমাদের দেখানোর জন্য হতে চাবি নিয়ে এলেন। রাজবাড়ির দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। উপরেও নীচের তলার মতোই চারদিকে লম্বা বারান্দা এবং বারান্দা লাগোয়া বহু ঘর। লম্বা বারান্দায় পিলারের সঙ্গে জাফরি লাগানো রয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো সেই জাফরির ভেতর দিয়ে দেওয়ালে পড়ছে। ফলে জাফরির নকশার ছায়া দেওয়ালে পড়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি হচ্ছে।
ইতিহাস আটকে আছে ঘরগুলোতে।
আমরা এবার দোতলার ঘরগুলো এক এক করে দেখতে শুরু করলাম। প্রথমেই যে ঘরে ঢুকলাম তার দেওয়ালে বিরাট দু’টি তৈলচিত্র ঝুলছে। ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ছবি দু’টির একটি ঈশ্বরচন্দ্রের এবং অপরটি অরুণচন্দ্রের। ভদ্রলোক আমাদের একটি ঘর দেখিয়ে জানালেন, এটি রাজারা ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করতেন। ঘরটিতে তালা মারা ছিল। বাইরের থেকেই দরজার একটি ভাঙা অংশ দিয়ে ঘরের ভেতরটি দেখা যাচ্ছিল। সেখানে একটি পুরনো ডাইনিং টেবিলও দেখলাম। আরও কয়েকটি ঘর ঘুরে যেটিতে ঢুকলাম সেটি ধুলো মাখা জঞ্জালে পরিপূর্ণ। তনুশ্রীদি প্রথমে সেই ঘরে ঢুকতে চাইছিল না। মিঠুদি সকলের আগে সেই ঘরে ঢোকে। ঘরে রাখা পুরনো বহু ছবি (রাজবাড়ির বিভিন্ন সদস্যদের) ও মানপত্র উদ্ধার করে। মিঠুদির উৎসাহ দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছিলাম। ওই ধুলো মাখা ছবিগুলি দিদি নিজে হাতে পরিষ্কার করে আমাকে এক এক করে দিচ্ছিল। আমি সেগুলোর ছবি নিচ্ছিলাম। ছবি নেওয়ার পর পুরো ঘরটি ঘুরে দেখলাম। ঘরটি বেশ অন্ধকার ছিল। তাই ঘরে আরও কী কী রয়েছে ঠিক মতো বোঝা গেল না। তবে কয়েকটি পুরনো বই দেখতে পেলাম। সেই সঙ্গে কিছু ম্যাপ ও আরও কিছু পুরনো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলাম। আসলে বাড়ি ফেরার বড্ড তাড়া থাকায় সেদিন আর তেমন ভাবে বাকি জঞ্জালগুলি ঘেঁটে দেখার অবকাশ ছিল না।
যেখানে দেখিবে ছাই…চেষ্টা চলছে।
দ্রুত সেই ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে যাই। ভদ্রলোক জানালেন, এই ঘরটি এক সময় রাজাদের রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। ঘরটিতে এখনও মাটির দু’টি চুলো রয়েছে। রান্নার সময় ধোঁয়া ঘরের বাইরের বার করার জন্য পাইপ লাগানো আছে। যার মুখ রয়েছে ছাদের উপরে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাকি ঘর দেখলাম। কিছুটা এগোতেই দেখি, একটি সিঁড়ি ছাদের দিকে যাচ্ছে। এই সিঁড়িটি দিয়ে রাজবাড়ির ছাদে যাওয়া যায়। সঙ্গী ভদ্রলোক ছাদে উঠতে নিষেধ করেন। কারণ সিঁড়ির অবস্থা খুব খারাপ। সিঁড়িতে আলোর ব্যবস্থাও নেই।
ছাদে ওঠার আশা ছাড়তে হল। এর মধ্যেই দেখি মিঠুদি আমাদের সঙ্গে নেই। সে আমাদের অলক্ষ্যেই ওই দুর্গম সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গিয়েছে। আমরাও দিদিকে অনুসরণ করে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছাদে উঠলাম। বিরাট ছাদ। সেখানে অনায়াসেই ক্রিকেট খেলা যাবে। আমরা ছাদের চারিপাশ ভাল করে ঘুরে, ছবি তুলে নীচে নামলাম।
বন্ধ খাবার ঘর।
এবার ফেরার পালা। তনুশ্রীদি কে বিদায় জানিয়ে আমি আর মিঠুদি এগিয়ে চললাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। মিঠুদি বলে বসল, কান্দির স্পেশাল দই না খাইয়ে কিছুতেই যেতে দেবে না আমাকে। মিষ্টির দোকানের পর্ব চুকিয়ে আমরা পুনরায় পা বাড়ালাম পথে। মিঠুদি জানাল, এখনও ‘ঘড়িখানা’ দেখা বাকি আছে।
মিষ্টির দোকান থেকে কিছুটা পথ এগোতেই দূর থেকে চোখে পড়ল একটি আর্চওয়ালা গেট। দিদি জানাল, এটিই ‘ঘড়িখানা’। এই গেটটি খুব সম্ভবত রাজবাড়ি বা রাধাবল্লভ মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথ হতে পারে। জনশ্রুতি রয়েছে, ফটকের মাথায় এক সময় নহবতখানা ছিল। এই ঘড়িখানার তলায় গিয়ে দেখি তাঁর মধ্যে দিয়ে চারদিকে চারটি রাস্তা চলে গিয়েছে। ঘড়িখানার মাথায় এক পাশে একটি বিরাট ও সুদৃশ্য ঝাড়বাতি লাগানো রয়েছে। যদিও এক সময় এই ঝাড়বাতিটি ঘড়িখানার একেবারে মধ্যেখানে লাগানো ছিল। এখন যেহেতু বড় বড় গাড়ি ঘড়িখানার গেট দিয়ে পার হয় তাই আপাতত ঝাড়বাতিটিকে তার আসল অবস্থান থেকে সরিয়ে এক পাশে লাগানো হয়েছে।
রাজবাড়ির প্রশস্ত ছাদ।
রাজবাড়ির এই প্রধান ফটকটি দেখার পরও সেখানে কোথাও ঘড়ির কোনও চিহ্ন দেখতে পাইনি। তাই মিঠুদিকে ফটকের নাম ঘড়িখানা কেন হল প্রশ্ন করলাম। দিদি জানায়, এক সময় একটা বড় ঘড়ি নাকি এই ফটকে লাগানো থাকত। ঘড়িখানা দেখে আমরা এবার এগিয়ে চললাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই বাস পেয়ে গেলাম। মিঠুদিকে বিদায় জানিয়ে উঠে বসতেই বাস ছেড়ে দিল বহরমপুরের উদ্দেশ্যে।
এক রাশ ভাললাগা নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম। পেছনে পড়ে রইল মিঠুদি আর একটা পুরনো শহর।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)