মুর্শিদাবাদ
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ইতিহাসের চাঁদপাড়া ও কারুকাজের খেরুর

ফারুক আবদুল্লাহ

বহুদিন থেকেই মন টানছিল মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির এক আনা চাঁদপাড়া গ্রাম। কেন টানছিল? বিভিন্ন তথ্য ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, এই চাঁদপাড়া গ্রামেই নাকি গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের বাল্যকাল কেটেছে। একসময় একা একাই ঘুরতে ভাল লাগত। কিন্তু দল বেঁধে ঘোরার মধ্যে অন্য ভাললাগা কাজ করে। তাই চাঁদপাড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমার কয়েকজন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণ সঙ্গীদের জানাই। তাঁরা ভীষণ আগ্রহ দেখায়। আলোচনায় স্থির হয় ১৫ অক্টোবর চাঁদপাড়া অভিযান হবে। অভিযানে যাবে প্রোজ্জ্বল হালদার, দিয়া রায়, ঊর্মিলা বিশ্বাস এবং সরিউল ইসলাম।

প্রোজ্জ্বল মুর্শিদাবাদ শহরেরই ছেলে। সে মুর্শিদাবাদ ট্যুরিজম বিভাগের বিভিন্ন প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত। সরকারি অতিথিদের ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবেও প্রোজ্জ্বলের বেশ নাম রয়েছে। শুধু ভাল গাইড হিসেবে নয়, খুব ভদ্র ও বিনয়ী হিসেবেই প্রোজ্জ্বলকে গোটা শহর চেনে। প্রোজ্জ্বলের আরও একটা পরিচয়, সে প্রত্নপ্রেমী। আর মুর্শিদাবাদ শহরের অলিগলি তাঁর হাতের রেখার মতোই চেনা। শুধু শহর বললে ভুল হবে, সমগ্র জেলার ইতিহাস নিয়ে ও যে ভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে ও একদিন এই জেলার পর্যটন শিল্পের অন্যতম মুখ হবে।

মণিগ্রাম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

দিয়াও মুর্শিদাবাদ শহরের মেয়ে। সে একজন অত্যন্ত গুণী টেক্সটাইল আর্টিস্ট। মুর্শিদাবাদ জেলাকে সমগ্র দেশ ও দেশের বাইরে তুলে ধরার স্বপ্ন নিয়ে সে ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। ইতিমধ্যেই দিয়ার কাজ সিমলা গেইটি আর্ট গ্যালারি, লখনউ ললিত কলা আকাদেমি, ওড়িশার রঘুরাজপুরে এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শিত হয়েছে। ওর আর্ট স্কুল রয়েছে। স্কুল এবং ওর তৈরি প্রোডাক্ট ব্যান্ডের নাম ‘আর্ট লাইফ ইন ক্রাফট রুম’। দিয়া টেক্সটাইল আর্টের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান আর্ট নিয়ে অনুশীলন করছে। মুর্শিদাবাদ শহরের এসিবিসি কলেজে ছাত্রীদের স্বনির্ভর করতে পটচিত্রের উপরে পাঁচ দিনের একক কর্মশালাও সে পরিচালনা করেছিল। দিয়া কত্থক, ভরতনাট্যমের গুণী নৃত্যশিল্পী এবং দক্ষ ফটোগ্রাফার।

জীবনের পথে।

ঊর্মিলা বিশ্বাস ওরফে ঊর্মি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে মেতে থাকে। ঊর্মি মুর্শিদাবাদের প্রসাশনিক ভবনে সিএমআরও ডিইও পোস্টে কর্মরত। ওর আসল পরিচয় একজন সমাজকর্মী হিসেবে। অসহায় দুঃস্থদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। ঊর্মি বিভিন্ন রক্তদান কর্মসূচির সঙ্গেও যুক্ত। ওর ভাললাগার অন্যতম বিষয় হল পাহাড়। এসব বাদেও ঊর্মি ‘গার্লস ওরিয়র’ ও ‘মুর্শিদাবাদি কন্যা’ নামক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ঊর্মির ’১৬ আনা বাঙালি’ নামে জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ রয়েছে। নেতাজির প্রতিও ঊর্মির অসম্ভব ভালবাসা।

সারিউল পেশায় সাংবাদিক। প্রিন্ট ও ডিজিট্যাল দুই মিডিয়াতেই সমানে কাজ করে চলেছে। খুব ভাল লেখে এবং ডিজিট্যাল মিডিয়ায় ভাল খবর উপস্থাপন করে। সারিউল খুব ভাল ছবিও তোলে।

গ্রামের জীবন।

চাঁদপাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় সেখানে যাওয়ার তেমন কোনও সহজ পথ নেই। আমাদের সফর সঙ্গীদের বাড়িও একেক এলাকায়। স্থির হয়, আমরা জঙ্গিপুর-শিয়ালদহ এক্সপ্রেস ধরে মণিগ্রাম স্টেশনে নেমে টোটোয় চাঁদপাড়া পৌঁছব। আমি আর ঊর্মি বহরমপুরের খাগড়াঘাট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরি। প্রোজ্জ্বল ও দিয়া ওঠে লালবাগ কোর্ট রোড স্টেশন থেকে। সারিউল আজিমগঞ্জ সিটি স্টেশন থেকে। প্রোজ্জ্বল ও সারিউল দু’জনেরই পেশা সংক্রন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সেদিন। কিন্তু ইতিহাস ছোঁয়ার নেশায় তারা কাজের ব্যবস্থা করেই কোনও রকমে এসেছিল। হয়তও আর কিছুটা দেরি করলেই ট্রেন পেত না। প্রোজ্জ্বল তো টিকিট কাটারই সময় পায়নি। পরের স্টেশনে সারিউল উঠত। ওকেই ফোন করে প্রোজ্জ্বলের টিকিট কাটতে বলা হয়েছিল।

চাঁদপাড়ায় এরকম বহু ঢিপি দেখা যায়।

আজিমগঞ্জ সিটি স্টেশনে সকলে এক হলাম বটে কিন্তু বসার সিটগুলোর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সিটে আরও কিছুজন আগে থেকেই বসে ছিলেন। এক সঙ্গে বসতে পারিনি। দিয়া আমাদের জানাল, একটা কামরা পরেই ফাঁকা আছে। হইহই করে সেই কামরায় ভিড় জমাই। নতুন কামরায় হঠাৎ করে আমার নাকে চন্দনের সুগন্ধ ভেসে আসে। এমনিতেই চন্দনের সুগন্ধ খুব ভাললাগে। কিন্তু গন্ধটা আসছে কোথা থেকে? কামরায় জানলার ধারে এক ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন। আমরাও পছন্দ মতো সিটে বসে পড়ি। শুরু হয় নানান বিষয়ে খোশ গল্প। দেখতে দেখতেই মহীপাল রোড স্টেশন পার হয়। জনশ্রুতি, এখানেই এক সময় পাল রাজা মহীপালের রাজধানী মহীপাল নগর ছিল।

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, গৌড়ের পাঠান সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইউয়জ শাহ আবার কারও মতে গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ নাকি পাল রাজাদের রাজধানী মহীপাল নগরের ধ্বংসাবশেষের পাথর ও মাল-মশলা দিয়ে নাকি কাছেই ‘গিয়াসাবাদ নগর’ নির্মাণ করেছিলেন। এখনও মহীপাল নগর এলাকায় প্রচুর উঁচু উঁচু ঢিবি রয়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকেই সেগুলো দেখা যাচ্ছিল। একটি রাজধানী শহর কালের গ্রাসে কী ভাবে প্রত্যন্ত গ্রামে পরিণত হয়ে গিয়েছে সে কথা ভাবলে কেমন লাগে।

এমন অংশ ছড়িয়ে রয়েছে।

ট্রেনে প্রোজ্জ্বল মুর্শিদাবাদের ইতিহাস নিয়ে, পর্যটন নিয়ে নানান পরিকল্পনার কথা শোনাচ্ছিল। সরিউল যাত্রাপথের প্রাচীন জনপদের নানান রূপের ছবি তুলে গিয়েছে কোনও কথা খরচ না করে। ঊর্মি আর দিয়া সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা বা লেখিকা মনে হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম ভদ্রমহিলার নাম মৌসুমী গাঙ্গুলি। তাঁর স্বামী মণিগ্রাম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত। তাঁরা সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা তাঁকে মুর্শিদাবাদ শহরের কিছু অফবিট সাইটের কথা বলি। দিয়া ওর মোবাইল থেকে আমীর মহলের ছবি দেখাতে শুরু করে ভদ্রমহিলাকে। উর্মিও তাতে যোগ দেয়। আমি ব্যাগ থেকে আতর বার করতেই ভদ্রমহিলা জানান, সেই চন্দনের সুগন্ধ নাকি তাঁর কাছ থেকেই আসছিল। তিনি ব্যাগ থেকে আতরের শিশি বার করে আমাদের হাতে মাখিয়ে দেন। আমার কাছে থাকা আতরও তাঁর হাতে লাগিয়ে দিই। আতরের আদান-প্রদানে আমাদের যাত্রাপথের মুহূর্তগুলি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। তিনি আমাদের তাঁর কোয়ার্টারে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয়। মৌসুমী জানান যে, আমাদের মতো তাঁদের সমবয়সিদের ঘুরতে যাওয়ার গ্রুপ রয়েছে।

দেখি তো এগুলো কী!

মণিগ্রাম স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। মৌসুমী ম্যাডাম আমাদের সঙ্গে তাঁর স্বামীর পরিচয় করিয়ে দেন। সত্যিই বলতে খুব ভাললাগার মুহূর্ত ছিল সেটা। মানুষ দু’টিকে দেখেই মনে হচ্ছিল তাঁরা যেন জীবনী শক্তিতে ভরপুর। তাঁদের বিদায় জানিয়ে আমাদের টোটো ধরার পালা। চাঁদপাড়া বলায় টোটোওয়ালাদের কেউ প্রথমে চিনতে পারছিল না। গন্তব্যের সামান্য বর্ণনা দিতেই একজন টোটোওয়ালা বলে উঠেন, ‘‘দরগাতলায় যাবেন?’’ টোটোওয়ালা আমাদের নিয়ে চাঁদপাড়ার দিকে এগিয়ে চলেন।

দরগাটি।

টোটোয় নতুন বিষয় নিয়ে আড্ডা শুরু হয়। পিচ রাস্তার দুই পাশে ধানের জমি আর গাছগাছালি। দূরে দেখা যাচ্ছিল মণিগ্রাম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমাদের টোটোর সঙ্গে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও যেন চলছিল। সারিউল কম কথা বলার মানুষ। সে সামনের সিটে বসে নানান ছবি তুলে যাচ্ছিল। প্রোজ্জ্বল নানান দৃশ্য দেখে বারবার বলে যাচ্ছিল, প্রথম এলেও পুরো এলাকাটি নাকি তার বড্ড চেনা মনে হচ্ছে। একথা শুনে সামনের সিটে বসা সারিউল মুচকি হেসে জানায় যে, প্রোজ্জ্বল নাকি পাল আমলের মানুষ। তাই তার এমন উপলব্ধি হচ্ছে। টোটোয় প্রোজ্জ্বল দিয়ার পরিচয় জানতে চাইলে আমি মজা করে জানিয়েছিলাম, বর্ধমান রাজ পরিবারের মেয়ে। প্রোজ্জ্বল একটুও সন্দেহ না করে জানিয়েছিল, দিয়া যে রাজপরিবারের মেয়ে তা ওকে দেখেই নাকি অনুমান করেছিল।

একে বলে নিরীক্ষণ।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গন্তব্যে। মাঝখানে সরু মেঠো পথ আর তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ ধানের জমি। পুরো মাঠ সবুজ হয়ে আছে। দেখেই মন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথায় সেই দরগাতলা। আমরা যে এলাকায় যাচ্ছিলাম সেখানে কয়েকঘর আদিবাসীর বাস। কয়েকজন বাচ্চাকে দেখে দরগাতলার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা আঙুল দিয়ে পথ দেখিয়ে দেয়। ভরা দুপুরে রোদের তাপ আমাদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সমস্যা হল, আমরা সংখ্যায় পাঁচজন হলেও ছাতা ছিল মাত্র দু’টি। সেই দু’টি ছাতা সবাইকে রোদের তীব্র তাপ থেকে কিছুটা বাঁচিয়েছিল।

এমন কারুকাজের নমুনাও রয়েছে।

কিছুটা যেতেই সকলে নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারিউল ভাই ধান গাছের ছবি তুলতে ব্যস্ত। দিয়াও রাস্তার পাশের জলাধারের ছবি তুলছে। যারা ছবি তুলছে ঊর্মি আবার তাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। প্রোজ্জ্বল সামনে এক আদিবাসী দম্পতিকে দেখে তাঁদের সাথে আলাপ জমিয়েছে। আমরা গিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা পাতা দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর দড়ি তৈরি করছেন। প্রোজ্জ্বলের ভাবনা, কী ভাবে আদিবাসীদের তৈরি সেই দড়িকে পর্যটকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। আমরা আদিবাসী দম্পতিকে বিদায় জানিয়ে কিছুটা এগোতেই দূর থেকেই দেখতে পাই, আমাদের গন্তব্য স্থান। স্থানীয়েরা যেটিকে দরগাতলা বলছিলেন। কিন্তু সামনে এগোতে আরও একটা বিপত্তি দেখা দেয়। রাস্তা পুরো কাদায় ডুবে রয়েছে। কোনও রকমে লাফিয়ে রাস্তা পার হলাম। তবুও কাদা আমাদের আলিঙ্গন করেই ছাড়ল।

অনেক গল্প বলা ভাল মানুষ দুই দিদি।

দীর্ঘক্ষণের যাত্রাপথ শেষে গন্তব্যে এসে সত্যিই ভাল লাগছিল। একটা উঁচু ঢিবির উপরে বড় বড় পাথরের তৈরি একটি কাঠামো। চারিদিকে পাথরের বিভিন্ন কাঠামো মাটির ভেতর থেকে মাথা বার করে আছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে ঢিবির উপরে ছোট বড় আকারের বহু পাথররের খণ্ড পড়ে আছে। ঢিবির সামনেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। ঊর্মি আর দিয়ার পা কাদায় ভরে গিয়েছে। ওরা ঢিবির একপাশে বসে কলাপাতা ছিঁড়ে তা দিয়ে পা ও জুতোর কাদ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। প্রোজ্জ্বল আর সারিউল এমন প্রাচীন পাথর দেখে অস্থির হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল। এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিতে আমিও ঢিবির একপাশে তেঁতুল গাছের ঠান্ডা ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।

ওই যে খেরুর মসজিদ।

বিশ্রামের ফাঁকে চাঁদপাড়ার ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক। বিভিন্ন তথ্য ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, হোসেন শাহের পূর্বপুরুষেরা আরবের বাসিন্দা ছিলেন। সুলতান হোসেন শাহ সুপ্রসিদ্ধ সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। হোসেন শাহের পূর্ব্বপুরুষেরা মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশীয় হওয়ায় ‘শরিফি মক্কী’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তবে একসময় হোসেন শাহের পিতা সৈয়দ আসরাফের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটলে তিনি দুই পুত্র হোসেন শাহ ও ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গদেশে এসে উপস্থিত হন। বর্তমান চাঁদপাড়ায় বাস করতে শুরু করেন। রিয়াজুস্ সালাতিন ও আরও কিছু তথ্যে চাঁদপড়ার উল্লেখ নেই। চাঁদপুর লেখা আছে। যদিও রিয়াজ উস সালাতিনে চাঁদপুরকে রাঢ় প্রদেশের অন্তর্গত হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। যার বর্তমান নাম চাঁদপাড়া।

কারুকাজ এমনই।

চাঁদপাড়ায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই হোসেন শাহের পিতা আসরফ ও ভাই ইউসুফ বিহারে চলে যান। হোসেন শাহ একাই চাঁদপাড়ায় থেকে যেতে বাধ্য হন। এক সময় হোসেন শাহের অবস্থা নানান কারণে এতটাই শোচনীয় হয়ে উঠে যে তাঁকে জীবন ধরণের জন্য অত্যন্ত ছোট পদের চাকরি গ্রহণ করতে হয়। কথিত, সেই সময়ে চাঁদপাড়ায় সুবুদ্ধি রায় নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি জমিদার হিসেবেও পরিচিত। হোসেন শাহ তাঁর অধীনেই সামান্য কাজে নিযুক্ত হন। সুবুদ্ধি রায় চাঁদ রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। চাঁদ রায়ের নাম থেকেও এলাকার নাম চাঁদপাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ও ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থে তিনি সুবুদ্ধি রায় নামেই উল্লিখিত হয়েছেন।

কারুকাজ মুগ্ধ সফরকারীরা।

স্থানীয় জনশ্রুতি, হোসেন শাহ নাকি সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে রাখল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। আবার চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায়, সুবুদ্ধি রায় হোসেন শাহকে নাকি দিঘি খনন করতে নিযুক্ত করেছিলেন। হোসেন শাহ যে একটি অতি সামান্য পদে চাকরি করতেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যদিও মুসলমান ঐতিহাসিকেরা সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে হোসেন শাহের চাকরি করার কথা কোনও লেখায় উল্লেখ করেননি।

কথিত, চাঁদপাড়ায় একজন কাজি (বিচারক) ছিলেন। তিনি হোসেন শাহের গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর হোসেন শাহ শ্বশুরবাড়িতেই বিদ্যাচর্চা শুরু করেন। সেই সময়ে হাবসি শাসক মুজাফফর শাহ গৌড়ের সিংহাসনে। হোসেন শাহের শ্বশুর কাজি সাহেবের সুলতানের দরবারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কাজি সাহেবের সঙ্গে সুলতানের সম্পর্ক ভাল থাকায়, তিনি হোসেন শাহকে সুলতানের দরবারে ভাল পদে নিযুক্ত করে দেন। হোসেন শাহের ভাগ্য খুলে যায়। হোসেন শাহের কাজে মুগ্ধ হয়ে সুলতান এক সময় তাঁকে উজির (প্রধানমন্ত্রী) পদে নিযুক্ত করেন।

দেওয়াল জুড়ে অসাধারণ সব পোড়ামাটির কাজ।

হাবসি শাসক মুজাফফর শাহ অত্যন্ত অত্যাচারী সুলতান ছিলেন। তাই তাঁর দরবারিরা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে হোসেন শাহকে গৌড়ের সিংহাসনে বসান। সিংহাসনে বসেও হোসেন শাহ তাঁর আগের প্রভু সুবুদ্ধি রায়ের কথা ভোলেননি। তিনি তাঁর সম্মান বৃদ্ধি করেন। সুবুদ্ধি রায়কে তাঁর নিজ গ্রাম চাঁদপাড়া নিষ্কর রূপে প্রদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুবুদ্ধি রায় সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় হোসেন শাহ চাঁদপাড়া অঞ্চলের জন্য মাত্র এক আনা কর ধার্য্য করেন। সেই থেকেই এই গ্রামের নামের সঙ্গে একআনা বা একআনি কথাটা জুড়ে যায়।

‘‘স্যার একটু এদিকে আসুন’’— প্রোজ্জ্বলের ডাকে হঠাৎ সম্বিত ফেরে আমার। মিষ্টি ছায়া আর দূরের ধান খেত থেকে হুহু করে আসা মিষ্টি হওয়ায় চোখ বুজে আসছিল আমার। প্রোজ্জ্বল যখন ডাকছে তখন নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ ব্যাপার সে লক্ষ্য করেছে। গিয়ে বুঝলাম, সে ঢিবির মধ্যিখানে অবস্থিত পাথরের ধাঁচ দেখে অনুমান করে ফেলেছে কেমন দেখতে ছিল সেই স্থাপত্যটি। বড় বড় পাথরের গায়ে দুই পাশে ছিদ্র করা। সে জানায়, হয়তো পাথর ধরে রাখতে এর মধ্যে লোহার তৈরি কোনও পাত জাতীয় কিছু লাগানো ছিল। প্রোজ্জ্বল পোড়ামাটির ইটের কিছু নিদর্শন দেখে জানায়, ‘‘স্যার, এখানে শুধু পাথরের নয়, পোড়া ইটেরও ব্যবহার করা হয়েছিল।” আমি তাকে জানাই, ‘‘ভাই তুমি খোঁজো মন দিয়ে। আমি তোমার কাছে পরে সব শুনবো।’’

শিল্পের নমুনা দেখে শিল্পীর মুগ্ধতা।

ঊর্মি আর দিয়া পায়ের কাদা মুছে কখন আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়েছে বুঝতেই পারিনি। ঊর্মি আর দিয়া ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছবি তুলতে। আমি পুনরায় গিয়ে সেই তেঁতুলতলার ছায়ায় গিয়ে বসি। এবার ওরাও বোধহয় কিছুটা ক্লান্ত হয়ে সেখানে এসে বসে। বসেই ওদের মনোযোগ গিয়ে পড়ে পাশের একটি পাথরের উপরে। তাতেও একটি গোল বড় ছিদ্র করা ছিল। ধুলোয় ভরা। ছিদ্র যুক্ত পাথরটি দেখে একেক জন একেক মন্তব্য করে যাচ্ছিল। কেউই বলল, ওটা নাকি মূর্তি বসানোর জন্য। কারও মত, পাথরটি সম্ভবত ঘরের পূর্ব দিকের দরজা বা জানলার কোনও অংশ হবে। ছিদ্রটি নাকি ঘরের মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশের জন্যই করা হয়েছিল। ঊর্মি এর মধ্যেই একটি গাছের ডাল খুঁজে ছিদ্রের মুখের ধুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। সারিউল একটা বড় ঝিনুক এনে ঊর্মির সঙ্গে যোগ দেয়। দিয়া পড়ে থাকা একটি বড় পাথরে বসে বিশ্রাম নেয়। প্রোজ্জ্বল খাতা পেন বার করে পাথরের ধাঁচার সম্ভাব্য পুরনো রূপটি আঁকতে শুরু করে।

দু’জন আদিবাসী মহিলা মাঠে কাজে যাচ্ছিলেন। আমরা তাঁদের থামিয়ে কথা বলতে শুরু করি। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল ঊর্মির। আদিবাসী মহিলা দু’জনের নাম ছিল মাইলু আর সুন্দরী। ওঁদের সঙ্গে আমরা নানান বিষয়ে কথা বলছিলাম। বিশেষ করে ওঁদের জীবন যাপন নিয়ে। ভাল লাগছিল ওদের ব্যবহার ও সরলতা দেখে। আমার তো মনে হচ্ছিল, সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এমন আদিবাসী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করি। আদবাসী দিদিরা জানান, এই দরগা নাকি সব ধর্মের মানুষের কাছেই খুব পবিত্র। গ্রামের সাধারণ মানুষ এই দরগায় মানত করেন। তাঁরা জানান, দরগায় মানত করলে নাকি সব মনোকামনা পূর্ণ হয়। এমনকি গ্রামের কারও মোবাইল হারিয়ে গেলে এই দরগায় মানত করলে নাকি সেই মোবাইলও ফেরত পাওয়া যায়।

অসাধারণ সব কাজ।

মাইলুদি জানান, তিনি তাঁর বাবা ও দাদুর মুখে শুনেছেন, ঢিবির উপরে একটি বড় পাথরের ঘর ছিল। ঘরের চারদিক ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই জঙ্গলে নাকি বাঘও থাকত। কারও বাড়িতে উৎসব অনুষ্ঠান থাকলে দরগায় বাসনপত্র চেয়ে প্রার্থনা করলে সেসব পাওয়া যেত। কী ভাবে এই বাসন আসত তা কেউই জানতেন না। তবে ব্যবহার করার পর বাসনপত্র ভাল করে ধুয়ে মুছে ফেরত দিতে হতো। একবার নাকি গ্রামেরই কোনও এক ব্যক্তি বাসন ব্যবহার করে না ধুয়েই ফেরত দিয়েছিলেন। সেদিনের পর থেকেই নাকি দরগা থেকে আর বাসনপত্র পাওয়া যায় না।

আমাদের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে দুই আদিবাসী দিদি কাজে বেরিয়ে যান। আমি একবার সেই ঢিবির উপরে উঠে ঘুরে আসি। অজস্র পোড়ামাটির ঘোড়া পড়ে আছে বড় বড় পাথরের উপর। ঢিবির মধ্যিখানে পাথরের সেই ঘরটি থাকলেও সেটির চারদিক জুড়ে আরও বড় এলাকা নিয়ে কোনও স্থাপত্য ছিল বলেই মনে হয়। পুকুরের দিকে মাটির ভেতরে থাকা দু’টি পাথরের পিলারের মাথা দেখা যায়। খুব সম্ভবত পুকুরে নামার সিঁড়ি বা ঘরের দরজা ছিল।

ফুলের শৈলী মুগ্ধ করেছিল।

আমার আর প্রোজ্জ্বলের ঢিবি দেখা হয়ে গেলেও ঊর্মি, দিয়া আর সারিউল তখনও সেখানেই ব্যস্ত। ঊর্মি খালি পায়ে ঢিবির মাথায় জঙ্গলে উঠে পড়েছে। আগেই শুনেছিলাম এখানে ভীষণ সাপের উপদ্রব। ঊর্মি আমাদের সমস্ত নিষেধ উপেক্ষা করে। দীর্ঘক্ষণ ঢিবির মাথায় ঘুরে অবশেষে নেমে আসে।

আমরা চাঁদপাড়া ঢিবি ছেড়ে এগিয়ে চলি গ্রামের আরও একটি ঢিবির উদ্দেশ্যে। সেই কাদা ভরা মেঠো পথ পার হয়ে। প্রখর রোদের তাপে বেশ কান্তি লাগছিল। কিছুটা হেঁটে দেখি এক বাড়ির উঠোনে জলের কল। বাড়ির এক সদস্য স্নান করছিলেন। আমাদের সেখানে যেতেই প্রবীণ এক সদস্য ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি গ্রামের ইতিহাস ব্যাখ্যা করছিলেন নিজের মতো করে। তাঁর সহজ সরল বর্ণনা শুনে মনে হল, তিনি যেন মাত্র কয়েক মাস আগের কথা বলছেন। তিনি জানান, সুলতান হোসেন শাহ নাকি এই গ্রামেই এক সময় ছাগল চরাতেন। সেই মধ্যযুগীয় গ্রামটি আজ কয়েক শতক পার করে এসে আরও প্রত্যন্ত হয়ে পড়েছে। আজও গ্রামের মেঠো রাস্তার দু’পাশের জমিতে রাখাল বালকেরা ছাগল চরাচ্ছে। সত্যিই ইতিহাসের কী অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি।

প্রবীণটি আমাদের আঙুল দিয়ে হাটপাড়ার অবস্থান দেখিয়ে জানালেন, সেখানে নাকি বেশ কয়েক বছর আগে উদ্ধার হয়েছে প্রস্তর যুগের বেশ কিছু নিদর্শন। আমাদের যাত্রাপথেই হাটপাড়া পড়েছিল। তবে আলাদা করে তেমন কিছু বোঝার উপায় ছিল না। এই চাঁদপাড়া ও হাটপড়ার প্রাচীনত্বের কথা ২০১১ সালেও পড়েছিলাম সংবাদপত্রে। গ্রামের চারিদিকেই বহু ঢিবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে শুনেছিলাম গ্রামে মাটি কাটলে নাকি নানান প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। স্বর্ণ মুদ্রা ও পাথরের পুরনো মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে বহুবার। আসলে এই এলাকাটি সেই প্রাচীন আমল থেকেই অত্যন্ত সম্মৃদ্ধ ছিল, অনুমান করা যায়। মধ্যযুগেও এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। শুধু ক্ষমতার হাত বদল ঘটেছিল মাত্র।

আমরা ভদ্রলোকের কাছে অন্য ঢিবির রাস্তা জেনে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল জঙ্গলে ঢাকা আরও এক উঁচু ঢিবি। সেই ঢিবির পাশেও রয়েছে একটি বিরাট পুকুর। পুরো এলাকা কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে ও অন্ধকার হয়ে আছে। ঢিবির উপরের অংশ বর্তমানে গ্রামের ইদগা। আমরা ঢিবির উপরে ওঠার সাহস পাইনি। গ্রামের কিছুজন আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, সাপের উপদ্রব নিয়ে। আমরা সেখান থেকে ফিরে পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে বেরনোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করি।

খেরুর। অনন্য রীতির নির্মাণ।

কিছুটা হাঁটার পর অবশেষে গ্রাম পেছনে ফেলে পাকা রাস্তা মেলে। টোটো ধরে পৌঁছে যাই চাঁদপাড়া মোড়ে। যেহেতু ট্রেন ধরার তাড়া ছিল তাই সকালে কিছুই খেয়ে আসা হয়নি। আর এগোনোর শক্তি পাওয়া যাচ্ছিল না। কী খাওয়া যায়? চোখে পড়ে এক ভদ্রমহিলা ভরদুপুরে নানান রকমের তেলেভাজা আর মুড়ি নিয়ে বসে আছেন। আসলে আমাদের মুর্শিদাবাদের বাগড়ি এলাকায় বিকেলে তেলেভাজা মুড়ি খাওয়ার চল। কিন্তু রাঢ় এলাকায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়া চলে।

অন্য কিছু না পেয়ে তেলেভাজার দোকানে গিয়েই বসলাম সবাই। দুপুরে খালি পেটে তেলে ভাজা খেতে বেশ ভয় হচ্ছিল। উপায়ও নেই। এদিকে ঊর্মির সেদিন বাইরের খাবার খাওয়া বারণ ছিল। দিয়ারও তেলেভাজায় আপত্তি। ফলে বলা হয়েছিল অন্তত দু’টি মুড়ি সব কিছু ছাড়া মেখে দিতে। আমাদের কথায় ভদ্রমহিলা বেশ নাখুশ হলেন। কোনও রকমে আমরা মুড়ি খেয়ে পাশের স্ট্যান্ড থেকে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরবর্তী গন্তব্য খেরুর মসজিদের উদ্দেশ্যে। চাঁদপাড়া থেকে প্রায় ১৭ কিমি।

প্রকৃতি এখানেও খুব ভাল। মৃদু মন্দ গতির টোটোয় নানান বিষয় নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম। এর মধ্যেই দিয়ার ফোনে বেজে উঠল আইভি ব্যানার্জির গলায় আমার খুব প্রিয় একটি গজল ‘দূর হে মঞ্জিল রাহে মুশকিল আলাম হে তানহায়ি কা’। মনোরম যাত্রাপথ, আড্ডা, গজল, আতরের শাহী খুশবু মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

ঘণ্টা খানিকের যাত্রা শেষে পৌঁছই খেরুর মসজিদে। মসজিদের কাছে বসতি গড়ে উঠলেও সংলগ্ন এলাকায় কিছুটা সবুজের ছোঁয়া অক্ষুণ্ন রয়েছে। খেরুর মসজিদটি মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। প্রাচীনত্ব এবং গায়ে টেরাকোটার কাজ মসজিদটিকে অন্যন্য করে তুলেছে। টোটো থেকেই মসজিদটি দেখে মন ভরে গেল। ইতিপূর্বে মুর্শিদাবাদ শহরে অজস্র নবাবি আমলের মসজিদ দেখলেও খেরুর গ্রামের এই মসজিদটি সত্যিই অন্য রকমের। কারণ মসজিদটির সময়কাল আলাদা। ফলে গঠন শৈলীও আলাদা। এই মসজিদটি গৌড়ের সুলতানি আমলের। ফলে গঠন শৈলীও অনেকটা গৌড়ের মসজিদগুলির মতোই।

খেরুর মসজিদে থাকা দু’টি আরবি শিলালিপির একটিতে তৎকালীন সুলতানের নাম লেখা আছে। কিন্তু অন্যটিতে নেই। তথ্যানুযায়ী, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) জনৈক রাফাত খান ৯০০ হিজরিতে (১৪৯৩-৯৫ খ্রিঃ) নাকি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।

তিন গম্বুজ যুক্ত একটি বারান্দা ও একটি বড় গম্বুজ যুক্ত (বর্তমানে গম্বুজটি ভেঙে গেছে) বর্গাকার প্রার্থনা কক্ষ রয়েছে। মসজিদে প্রবেশের পাঁচটি রাস্তা রয়েছে। বাংলায় প্রচলিত টেরাকোটার অপূর্ব অলঙ্করণে মসজিদটিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৬ মিটার, প্রস্থ ৩২ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ২৪ ফুট। মসজিদে টেরাকোটার কাজের মধ্যে ফুল বিশেষ করে গোলাপ ফুলের প্রাধান্য লক্ষণীয়।

সবাই দেখি মসজিদটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। যে যেমন ভাবে পারছে মোবাইল ক্যামেরায় মসজিদটির বিভিন্ন প্রান্তের ছবি তুলতে শুরু করেছে। আমরা মসজিদে প্রবেশ করতেই দেখি গ্রামের বেশ কিছু প্রবীণ মহিলা ও পুরুষ মসজিদ চত্বরে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। আসলে তাঁরা আমাদের ‘সরকারি লোক’ ভেবেছিলএন। আমরা তাঁদের বিশ্বাস না ভেঙে প্রোজ্জ্বল ভাইকে দেখিয়ে দিই ‘সরকারি লোক’ পরিচয় দিয়ে। গ্রামবাসীরা প্রোজ্জ্বলকে ঘিরে ধরে নানান অভাব অভিযোগ ও মসজিদটি নিয়ে তাঁদের নানান চিন্তা ভাবনার কথা জানাতে থাকেন। দিয়া, ঊর্মি ও সরিউল আগেই মসজিদের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। সত্যিই অপূর্ব মসজিদ। এমন নয় যে এমন মসজিদ আগে দেখিনি। গৌড়ে একই সময়কাল ও স্থাপত্য রীতির প্রচুর মসজিদ রয়েছে। তবে মুর্শিদাবাদে এমন এই একটি মসজিদই অক্ষত রয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন আমি গৌড়ের কোনও মসজিদে এসেছি।

মসজিদের দেওয়ালের নানান জায়গায় পোড়ামাটির কারুকার্য। মসজিদের পশ্চিমের দেওয়ালে বিশেষ করে মিম্বরের গায়ের কারুকার্য সত্যিই দেখার মতো। মসজিদের ভেতরের বড় গম্বুজ ভাঙা তা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। যদিও কালো ত্রিপল দিয়ে ছাদের খোলা অংশ ঢাকা দেওয়া হয়েছে। দিয়া আর ঊর্মি বাইরে বেরিয়ে বাইরে থেকে বিভিন্ন দিক থেকে মসজিদের সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। সারিউল ভাইও মসজিদের ভেতরের দেওয়ালের নানান কারুকার্যের ছবি তুলতে হয়ে পড়েছে। আমি সাধারণত নিজের ছবি তুলতে খুব একটা পছন্দ করি না। তবুও এই অসাধারণ কারুকার্য খচিত মসজিদে এসে নিজস্বী তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। সকলে একত্রিত হয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তুলিয়ে নিই আমাদের টোটো চালককে দিয়ে।

দিয়া শিল্পী মানুষ। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এমন কারুকার্য খচিত মসজিদে ঢুকে সে যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছে। কখনও মসজিদের লতাপাতা ফুলের কারুকার্য করা দেওয়াল জড়িয়ে ধরছে, আবার কখনও টেরাকোটার লতাপাতা ফুলের গায়ে আলতো হাত বোলাচ্ছে। দিয়া জানায়, সে মুর্শিদাবাদ সিল্কের উপরে এই মসজিদের টেরাকোটার নকশাগুলো আঁকবে। কয়েক শতাব্দী পুরনো অবহেলিত মসজিদের গায়ে খোদিত টেরাকোটার কাজ দিয়া পুনরায় তুলে আনতে চাইছে সেটাই খুব আনন্দের কথা।

এর মধ্যেই অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। আমাদের টোটোওয়ালাও ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আচরণে সে কথা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছিল। আমাদেরও ট্রেনের সময় হয়ে আসছিল। মসজিদের বাইরে বেরিয়ে আরও একবার সবাই মিলে ছবি তুলে টোটোয় উঠে বসি।

কয়েক শতাব্দী পুরনো খেরুর মসজিদ পিছনে ফেলে এগিয়ে চলি। এক সময় খেরুর মসজিদ ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায় দৃষ্টি থেকে। তবে মনে জ্বলজ্বল করছিল খেরুর মসজিদের মনোমুগ্ধকর টেরাকোটার কারুকার্য।

কভারের ছবি— খেরুর মসজিদ

ছবি— দিয়া, ঊর্মি, প্রোজ্জ্বল ও লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *