দীপক দাস
সুকুমার রায় এ ট্রেনে চাপলে আর ‘একটু জল পাই কোথা?’ লিখতেন না। হয়তো তাঁর মনে হত, এত জল পায় কোথা? বা এত জল যায় কোথা? নিশ্চয়ই যাত্রীদের পেটেই যায়। না হলে এত আধুনিক ভিস্তিওয়ালা কামরায় উঠছেন কেন?
জলই জীবন। আমরা জানি। সে জন্য চারজনের ব্যাগেই রয়েছে জীবনের বড় বড় বোতল। আসানসোলে নেমে খালি হয়ে যাওয়া একটি বোতলে জীবন ভরে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি আর দীপু। মেলেনি পানের যোগ্য কোনও জল। ঠান্ডা জলের বোতল বা জল ফেরিওয়ালা নিয়ে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। মনটা কেমন করছে ট্রেনের খাবার নিয়ে। কিছুই উঠছে না। অবশ্য গভীর রাত পার করা ট্রেন। খাবারের চেয়ে জলই বেশি প্রয়োজন বোধহয়। এদিকে সফরে বেরিয়ে ট্রেনের খাবার না খেলে ভারী মন খারাপ হয় আমাদের। কিন্তু ট্রেনে শুধু জলের বোতলই উঠছে।
আমরা চলেছি শিমুলতলায়। বাঙালির পশ্চিম বলে পরিচিত ছিল বিহারের এই জায়গাটা। কিন্তু ট্রেনের যা মতিগতি তাতে মনে হচ্ছে, পশ্চিম ছাড়িয়ে দক্ষিণে গিয়ে থামবে। উঠেছিলাম বর্ধমান মেমুতে। বর্ধমান পৌঁছে সেই ট্রেন হল আসানসোল মেমু। আসানসোল থেকে জসিডি হল। সহযাত্রীদের কথায় বুঝছি, জসিডি থেকে ঝাঝা মেমু হবে। ট্রেনযাত্রী আমাদের অবস্থা তখন রাবীন্দ্রিক। কোথায় যেন তিনি লিখেছিলেন, আমাদের কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের শুধু বর্তমান। সেটাই বেড়ে বেড়ে চলে। তা চলুক। খাবারও উঠুক।
খাবার যে একদম ওঠেনি তা নয়। বর্ধমান স্টেশনে চায়ে গর্ম হেঁকেছে। জানলা দিয়ে পুরি পুরি শুনেছি। ভোরবেলা চা খাওয়ার বিপদ আছে। প্রকৃতি অস্থির হয়ে ওঠে কাছে পেতে। আর পুরিতে আগ্রহ নাই। আমরা ট্রেনের ঝালমুড়ি পছন্দ করি। মালদহ থেকে ফেরার সময় ট্রেনে কাসুন্দি দিয়ে পেয়ারা মাখা উঠত। এরকম কিছু খাবার চাইছিলাম। মেলেনি। ট্রেনের খাবার প্রথম মিলল পরের দিন। ট্রেনের মতিগতি দেখে মধুপুরে আমরা যাত্রাভঙ্গ করেছিলাম। না হলে হয়তো সে দিনেই মিলত।
ছানার মুড়কি।
সফরের প্রথম খাবার মিলল মধুপুরে। এলাকা ঘোরার সময়ে। ছানার মুড়কি। তবে প্রথম খেয়েছিলাম শিঙাড়া। তার পর চা। শাস্ত্র মেনে শেষ পাতে মিষ্টি। শিঙাড়া কেনা হয়েছিল দু’জায়গা থেকে। মিষ্টির দোকান আর স্টেশনের সামনে পানের দোকানের স্টলের পাশ থেকে। তখন মধুপুর চষে ফেলার পরে সন্ধে নেমেছে। দুপুরের সাত্ত্বিক আহার ডাল, ভাত, আলু চোখা স্বাভাবিক দৌড় ঝাঁপ আর মধুপুরের জলের গুণে বিলীন হয়েছে। ‘একটুও বেঁচে নেই’। টিফিন কিছু করতেই হত। অটোচালকদাদাকে জিজ্ঞাসা করে দোকান চিনলাম। তার আগে একটা দোকানে ছানার মুড়কি কিনতে গিয়ে শিঙাড়া কিনে এনেছিলাম। কলকাতায় যাকে বলে অবাঙালি শিঙাড়া সে রকই প্রায়। খুব একটা ভাল লাগেনি। পানের স্টলের পাশের দোকানের শিঙাড়া তুলনামূলক ভাল খেতে। তবে পুরে মশলার প্রতাপ বেশি। ঠোলটা ভাল নয়। আকারেও ছোট। সব মিলিয়ে প্যাকেজ ঠিক শিল্পসম্মত নয়। চা বেশ সুস্বাদু ছিল। এটা স্বীকার করতেই হবে।
মজা হল ছানার মুড়কি খেতে গিয়ে। সন্ধান দিয়েছিল আমাদের গার্ডবাবু। সফরের সঙ্গী হতে পারেনি। কিন্তু দূর থেকে গার্ড করে গিয়েছে দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র সামলানোর মতো। ট্রেনটা ওরই দেখে দেওয়া ছিল। যে ট্রেনের মতিগতি দেখে মধুপুর স্টেশনে নেমেই ইন্দ্রর স্মরণীয় উক্তি ছিল, ‘‘এক ট্রেনে ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছি মনে হচ্ছিল।’’ গার্ডবাবু সৌগত বলেছিল, মধুপুরের ছানার মুড়কি নাকি বিখ্যাত। শুনে ভালই লাগল। ঘুরতে গিয়ে যদি মিষ্টি মেলে মজা দ্বিগুণ। ভাল ছানার মুড়কি মেলে এমন দোকান দেখিয়ে দিয়েছিলেন অটোচালক দাদাই। বাজারের দিকে দোকানটা। খাওয়ার সময়ে দেখি, ও বাবা এ যে ছানার গজার ছোট ভাই! স্বাদে এবং আকারে। ইহা রে মুড়কি কয়! নামে কী আসে যায়! স্বাদ হলেই হল। ভালই ছিল স্বাদ।
মধুপুরের মুড়কি দিয়েই প্রথম দিনের সফরের খাওয়া শেষ। রাতে রুটি-মাংসের ব্যাপারটা ঘরোয়া ধরে নিয়ে বলা।
ভাজা লিট্টি চোখা। জসিডিতে।
পরদিন যাত্রা শুরু শিমুলতলার দিকে। সেই ট্রেন, সেই জলওয়ালাদের ‘ঠান্ডা পানি’র হাঁকডাক। তবে এই ট্রেনে অন্য খাবারও উঠেছিল। এমনকি আমাদের ঝালমুড়িও। এ সব আমরা পেলাম জসিডি স্টেশনে। আসলে ট্রেন তখন আসানসোল থেকে দৌড়ে এসে জসিডিতে হাঁফ ছাড়ছে ঝাঝা মেমু হবে বলে। শিমুলতলায় নেমে ভারী টিফিন করব বলে ট্রেনের খাবারে মন দিইনি। কিন্তু স্বাদের অভিজ্ঞতা করে নেওয়া দরকার। আমাদের কাছে সফরের স্মৃতি যে খাবারদাবারও।
আমাদের পরিচিত সেঁকা লিট্টি চোখা।
নেওয়া হল ঝালমুড়ি। এক ঠোঙা ২০ টাকা। কোনও দিক দিয়েই ভাল লাগল না। চালভাজার থেকে একটু বড় মুড়ি। চাল ভাজার থেকে একটু নরম। মুড়ির মশলা ভাল নয়। ঝালমুড়ির যে পরিচয় চিহ্ন সেই নারকেল আর আচার নেই। ট্রেনের কামরায় আরেকটা কিছু বিক্রি হচ্ছিল। গোল গোল মোটা মোটা। ফেরিওয়ালার হাঁক শুনে বুঝলাম লিট্টি চোখা। কিন্তু এমন কেন? লিট্টি চোখা কলকাতাতেই খেয়েছি। এমন তো দেখিনি! নেওয়া হল এক প্লেট। চারটে ৩০ টাকা। এবার বুঝলাম। আমরা যে লিট্টি চোখা দেখে অভ্যস্ত সেটা সেঁকা। আর ট্রেনের লিট্টি চোখা তেলে ভাজা। ডালপুরির মতো। শুধু পুরে ডালের জায়গায় ছাতু দেওয়া। এক প্লেট টিফিন হিসেবে ভরপেট্টা। আমরা নিয়েছিলাম এক প্লেটই। স্বাদের সাক্ষী হতে। সঙ্গে দেওয়া আচারটা ভালই লেগেছিল।
লিট্টি চোখা। আচার সহযোগে।
জসিডিতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের কামরায় আরেকজন হকার যাতায়াত করছিলেন। হাতে তাঁর বালতি। তাতে ছোলা সেদ্ধ রয়েছে দেখলাম। প্রায় শুকনো। আমাদের চেনা খাবার বলে তেমন আগ্রহ দেখাইনি। গল্প, খাবার নিয়ে আলোচনা চার জনের পরস্পরকে পা টানাটানির কারণে ফেরিওয়ালার হাঁকটা কানে আসেনি। হঠাৎই কানে এল, বালতিওয়ালা গরম ঘুগনি বলছেন। বালতি করে ঘুগনি! তাকাতেই হল বালতির গভীরে। কিছুটা জল আর মশলা দিয়ে নাড়ানাড়ি আছে মনে হল। আচ্ছা, যাহা আমাদের সেদ্ধ চানামশলা তাহাই এখানে ঘুগনি। ছানার মুড়কির মতো। যাহা ছানার গজা, তাহাই ছানার মুড়কি। জায়গা বদলেছে, নামও।
শিমুলতলায় নেমে স্টেশনের বাইরেই বাজার। কিন্তু খাওয়া মাথায় উঠল। কিছুই নেই। বেলা ১১টার মধ্যে সব দোকানে স্টলে খাবার শেষ। একটা ছোট্ট স্টলে তাওয়ার উপরে একটাই লুচি পড়ে। ও লুচি কার গালে দেব! ইন্দ্র রেগে যাবে। খিদের আগুনে লুচির ঘি দেওয়ার জন্য। একজন জানালেন, ছোট বাজার তাই বেশি বেলা পর্যন্ত কিছু হয় না। বেশি করেও কিছু হয় না।। মিষ্টির দোকানে অবশ্য পাঁজা পাঁজা বালুশাহি আর গজা রয়েছে। কিন্তু খালি পেটে মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছিল না। খাবার না পেয়ে মনে হচ্ছিল, ট্রেনের লিট্টি চোখা ভরপেট খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল। ইন্দ্রর বিশেষ ভাবে ভেজে আনা চিড়ের ভরসায় বেরিয়ে পড়েছিলাম শিমুলতলা দেখতে। অটোয় করে।
তৈরি হচ্ছে গরম রসগোল্লা। শিমুলতলায়।
শিমুলতলার সফর শেষে বিকেলে খেয়েছিলাম এক হোটেলে। মাটির দেওয়ালের হোটেল। আদিবাসী মালিক নিজেই বলেছিলেন, ঝোপড়ার হোটেল। আমি আর দীপু খেয়েছিলাম নিরামিষ। ইন্দ্র আর বাবলা খাসির মাংস। আমাদের পাতে ডাল আর পেঁপে-ছোলা দিয়ে একটা তরকারি। মালিক ডাল দিচ্ছিলেন হাঁড়ি থেকে। খেয়েদেয়ে উঠে ইন্দ্র বলল, ‘‘মাংসের ঝোলটা অপূর্ব করেছে।’’ যদিও বাবলার দাবি, মাংস ছেঁড়া যাচ্ছিল না। সন্ধেবেলা আমরা অনেকক্ষণ শিমুলতলা স্টেশনে ছিলাম। বাজার পেরিয়ে গভীর নলকূপ থেকে জল আনতে গিয়ে দেখি, সেই হোটেলে কারা যেন গ্যাস জ্বালিয়ে বড় কড়াইয়ে রান্না করছেন। দেখে মনে হল, পুজোর ছুটিতে ঘুরতে আসা লোকজন। হোটেলের ভেতরে স্বপাক রন্ধনের কারণ অবশ্য জানা ছিল না।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে ট্রেন। শিমুলতলা স্টেশনে দীর্ঘ অপেক্ষা। যে শিমুল গাছটার জন্য জায়গার নাম হয়েছে সেটি চোখে পড়েনি। তবে আমরা যতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিলাম ততক্ষণ নতুন কোনও শিমুল চারা বসালে শিকড় চারিয়ে দিত। বসে থাকতে থাকতে রাতের খাবারের চিন্তা হল। আবার বাজার যাওয়া। কিন্তু রুটি, লুচি, পরোটা, চপ কিছুই নেই। মিষ্টির দোকানগুলোয় তখন গরম রসগোল্লা হচ্ছে। আর শিঙাড়া রয়েছে। ঠিক হল মুড়ি আর শিঙাড়া নেওয়া হোক। এ দিয়েই ট্রেনে রাত কাটাতে হবে। আর শেষ ক্যারিব্যাগে গরম রসগোল্লা। পাতের ব্যবস্থা করা যায়নি। মুড়ির দোকান থেকেই কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ নিতে হয়েছিল ট্রেনে বসে খাওয়ার জন্য। শিঙাড়ার আকার বড় নয়। তাই দু’টো করে নেওয়া। এসব খেয়ে রাতে এক পেট জল খেয়ে নিয়ে যা অম্বল হবে তাতে হাওড়া পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যাবে। গরম রসগোল্লা তৈরি করা দেখতে দেখতে প্রচুর বকেছিলাম দোকানদারদের সঙ্গে।
শিমুলতলা স্টেশনে বসে একটা জিনিস খেয়েছিলাম। বোঁদে। অপূর্ব খেতে। সে কিন্তু কোনও দোকানের নয়। স্টেশনের পাশে দুর্গাপুজো হচ্ছিল। বোঁদে বিলি হচ্ছিল পুজোর প্রসাদ হিসেবে। আমি পুজোর খোঁজ নিতে গিয়ে প্লাস্টিকের দু’বাটি বোঁদে এনেছিলাম। ইন্দ্র যুক্তিবাদী। সে প্রসাদ খাবে না। বলা হল, খাবার হিসেবে খা। তা-ও রাজি নয়। আমি, দীপু আর বাবলা ভাগ করে খেলাম। মৌড়ি দেওয়া বোঁদে। আগে কখনও খাইনি। মৌড়ি বোঁদের স্বাদ অন্যরকম করে দিয়েছিল। আর বোঁদের নিজস্ব স্বাদও যথেষ্ট ছিল। এত ভাল খেতে যে দীপু আর বাবলা আবার গিয়ে বোঁদে নিয়ে এসেছিল। প্রসাদ বিলি করা সিংজি আরও দিতে চেয়েছিলেন আমাদের। ট্রেনে বসে খাওয়ার জন্য। আমরা চক্ষুলজ্জায় নিইনি।
দুর্গাপুজোর সেই প্রসাদি বোঁদে। মৌড়ি দেওয়া।
রাতে মোকামা এক্সপ্রেসে নৈশভোজ কেমন হয়েছিল? পশ্চিমে মুড়ি আর শিঙাড়া ঠিক আমাদের জিভের পক্ষে সুবিধের নয়। আর রসগোল্লা? দীপু যখন ক্যারিব্যাগে দিল তখন চুপসে কাচের গুলির মতো হয়ে গিয়েছে। গরম অবস্থায় ক্যারিব্যাগে বন্দি করা হয়েছিল। একে বেচারা রসে হাবুডুবু খেতে পারেনি তার উপরে ব্যাগে থাকার চাপ। হাওয়া বেরিয়ে গিয়েছিল শিমুলতলার রসগোল্লার। পরে বাবলা বলেছিল, ওর ভাগের একটা শিঙাড়া নাকি শুধুই ঠোল। ভেতরে পুর বলে কিছু ছিল না!
বেচারা বাবলা! নাকি বেচার শিঙাড়া। নাকি শিঙাড়া রূপী শিমুলতলার নিমকি!
কভারের ছবি— জসিডিতে ট্রেনের কামরায় লিট্টি চোখা
ছবি— ইন্দ্র, বাবলা, দীপু
(সমাপ্ত)