গয়সাবাদ, জিয়াগঞ্জ।
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

সুলতানি আমলের এক সমৃদ্ধ নগরীর সন্ধানে- পর্ব ১

ফারুক আব্দুল্লাহ

গিয়াসাবাদ বা গয়সাবাদের কথা প্রথম পড়েছিলাম মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে। বছর দশেক আগে। কিন্তু নানান কারণে সেখানে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। সত্যিই বলতে গয়সাবাদে যাওয়ার তাগিদও আগে তেমন অনুভব করিনি। তবে গত কয়েকমাস ধরে গয়সাবাদ আমাকে খুব টানছিল। হঠাৎ করেই আমরা গয়সাবাদ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।

আমরা বলতে আমি আর অঞ্জন দাস বাবুর কথা বলছি। অঞ্জনদা অত্যন্ত গুণী ও মিশুকে মানুষ। তাঁর অন্য পরিচয় তিনি একজন রোমান্টিক কবি এবং নেতাজি গবেষকও। অবশ্য দাদা সদ্য মীরজাফরে মজেছেন। তাঁকে নিয়েই চলছে দাদার নতুন গবেষণা।

ফোনে দাদার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করি, পরের দিন গয়সাবাদে যাব। কিন্তু দু’জনের কেউই পথ চিনতাম না। গুগল ম্যাপে দেখি, বহরমপুর থেকে অনেক দূর দেখাচ্ছে। বহু খুঁজে একটি রুট উদ্ধার করি, কান্দি হয়ে। কিন্তু সেই রুট দিয়ে গেলেও অনেক দূর হয়ে যাবে। এর মধ্যেই হঠাৎ মাথায় আসে গোপালবাবুর কথা। গোপালদা শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অজিমগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ, সাগরদিঘি এলাকার ইতিহাস নিয়ে কাজ করে চলেছেন। দাদার কাছেই জানতে পারি, গয়সাবাদ আজিমগঞ্জ হয়ে খুব সহজে যাওয়া যায়।

মুর্শিদাবাদ
মীরজাফরের সমাধিতে ফুল অঞ্জনদার।

পরিকল্পনা মতো ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের ৯ তারিখ দুপুর ১২:৩০ নাগাদ অঞ্জনদার মোটর বাইকে চড়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। দাদার সঙ্গে সে দিন দেখা হতেই নজর পড়ে মোটর বাইকের হ্যান্ডেলে রাখা এক গুচ্ছ লাল গোলাপের দিকে। একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করতে দাদা অকপটে উত্তর দেন, এই গোলাপ বাংলার নবাব মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খানের জন্য। তাঁর সমাধিতে গোলাপ দিয়ে তবেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

দাদার বাইক বহরমপুর-খাগড়া হয়ে গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে চলল জাফরাগঞ্জে বাংলার নাজাফি বংশীয় নবাব পরিবারের সমাধিস্থলের দিকে। দাদার সঙ্গে ইতিহাসের নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে এক সময় এসে পৌঁছই মীরজাফরের সমাধিস্থলে। টিকিট কেটে ফুলের তোড়া নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি, সমাধিস্থলের দেখভালের কাজে নিযুক্ত মানুষগুলো কৌতূহল নিয়ে দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদা মীরজাফরের সমাধিতে ফুলের তোড়াটি রাখতেই সমাধিস্থলের দায়িত্বে থাকা সবাই আমাদের কাছে ছুটে চলে আসেন। আমি তো ভাবছিলাম হয়তো এ ভাবে সমাধিতে ফুল দেওয়ায় তাঁরা আপত্তি জানাবেন। কিন্তু না, দেখলাম তাঁরা সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। আমরা যে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করেছি তাতেও দেখি তাঁরা অনুশোচনায় ভুগছেন। তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় জানাই।

সমাধিস্থল থেকে বেরিয়ে মীরজাফরের বাড়ির মূল ফটক ও তার সামনে অবস্থিত নবাব পরিবারের এক পুরনো আম বাগান ফাইয়াজ বাগে যাই। কারণ সে দিনই এই আম বাগান নিয়ে একটি দৈনিকে আমার লেখা বেরিয়েছিল। মনে হল এসেছি যখন তখন বাগানটি একবার ঘুরে যাই।

এর পর আমাদের আসল গন্তব্য। যদিও গয়সাবাদ যেতে তখনও বহু পথ বাকি। আমাদের মুর্শিদাবাদ শহর ত্যাগ করে জিয়াগঞ্জে যেতে হবে। সেখান থেকে নদী পার করে আজিমগঞ্জ এবং সেখান থেকে আরও প্রায় ৭-৮ কিমির পথ গয়সাবাদ। আমরা প্রথমে জিয়াগঞ্জের নিমতলা ঘাট থেকে নৌকা করে আজিমগঞ্জে পৌঁছে সেখানকার স্থানীয় মানুষদের কাছে গয়সাবাদ যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তাঁরা আমাদের একটি রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে জানান, এই রাস্তা ধরে একেবারে সোজা চলে গেলেই গয়সাবাদ।

কিন্তু সেই সোজা পথ আর সোজা থাকে না। মাঝে বেশ কয়েকবার রাস্তা পরিবর্তন করতে হয়। পথে বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগিয়ে চলি আমরা। এপ্রিল মাসের তীব্র রোদের তাপ। রাস্তার দুই পাশে প্রচুর আম গাছ। ছোট ছোট আম ধরেছে। সত্যিই এ এক মনোরম দৃশ্য। যেতে যেতে কখন রাস্তার পাশে ভাগীরথী নদী এসে পড়েছে। নদী থেকে আসা মনোরম হাওয়া মন ভাল করে দিচ্ছে। বুঝতেই পারছিলাম, আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে খুব বেশি দেরি নেই।

আপনাদের হয়তো মনে হচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদে এত কিছু থাকতে হঠাৎ এই গরম দুপুরে আমরা গয়সাবাদে কী করতে যাচ্ছি? পৌঁছবার আগে আপনাদের গয়সাবাদের ইতিহাস জানিয়ে রাখি।

যাত্রা শুরুর আগে সেই নবাবি বাগানে।

গয়সাবাদ জঙ্গিপুর মহকুমার সাগরদিঘি থানার প্রত্যন্ত গ্রাম। অথচ এই গ্রামটি ত্রয়োদশ শতকে সুলতানি আমলে ছিল একটি সমৃদ্ধ নগরী। তারও আগে পাল আমলে গয়সাবাদ তৎকালীন মহীপাল নগরের অংশ ছিল বলে জানা যায়।

পরবর্তী সময় সুলতানি আমলে গৌড়ের সুলতান গিয়াসুদ্দিনের নাম থেকেই এই স্থানের নাম গয়াসাবাদ হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, কোন গিয়াসউদ্দিনের আমলে এই নগরী গড়ে উঠেছিল? কারও মতে, গৌড়ের পাঠান সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইউয়জ শাহের আমলে। আবার কারও মতে, গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহের আমলে। দুই সুলতানের আমলেই এই নগরী নির্মাণের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ দুই সুলতানই ছিলেন যোগ্য ও ক্ষমতাবান।

কথিত, পরবর্তী সময়ের পাল রাজাদের রাজধানী মহীপাল নগরের ধ্বংসাবশেষের উপরেই নাকি এই গিয়াসাবাদ বা গয়সাবাদ নগরীটি নির্মিত হয়েছিল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, গয়সাবাদ বা গিয়াসাবাদের পূর্বনাম ছিল বুধরহাট (বুদ্ধের হাট)। পরে তা বিকৃত হয়ে ভাদুরীহাট নামে পরিচিত হয়।

রাস্তা থেকে দেখতে পাওয়া তুলসীবিহার মন্দির।

গয়সাবাদ নগরী যে তেরো শতকে পাঠান রাজত্বকালে সৃষ্ট সেই বিষয়ে পণ্ডিতরাও এক মত। ক্যাপ্টেন ডব্লিউ.এইচ. শেরউইল তাঁর এক লেখায় গিয়াসাবাদকে কোনও প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ হিসেবেই উল্লেখ করেন। ক্যাপ্টেন জে ই গ্যাসট্রেলও এই নগরীরকে সুলতানি আমলে নির্মিত নগরী বলেই উল্লেখ করেছেন।

এখনও ভাগীরথী নদীর তীরে প্রাচীন গয়সাবাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। সেকালে মহীপাল ও গয়সাবাদের কাছাকাছি সাতটি হাট ছিল। সেগুলোর নাম দস্তুরহাট, বাগানহাট, সরাইহাট, গোপালহাট, ভুঁইহাট, হুঁকায়হাট ও লক্ষ্মীহাট। এই সাতটি হাট থেকেই একসময় নাকি ‘এক হাটে কিনে সাত হাটে বিক্রি’ প্রবাদটি প্রচলিত হয়েছে। এখনও হাট নাম দেওয়া গ্রামগুলো সাগরদিঘি থানার অন্তর্গত।

বহরমপুরের তৎকালীন এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন লেয়ার্ড ঐতিহাসিক অনুসন্ধান শেষে উল্লেখ করেন, গয়সাবাদে একটি ঐতিহ্যশালী বৌদ্ধ জনপদ ছিল। তিনি গয়সাবাদ থেকে সূক্ষ্ম কারুকার্যময় পাথরের স্তম্ভ, পালি ভাষায় লেখা শিলালিপি, বহু খণ্ডিত পাথর, বিভিন্ন পাথরের মূর্তি, জামার বোতামের আকারের স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করে ১৮৫২ সালে সিদ্ধান্তে আসেন যে, গয়সাবাদ এক সময় বৌদ্ধ জনপদ ছিল। গয়সাবাদে প্রাপ্ত পালি ভাষার শিলালিপি এবং স্বর্ণমুদ্রা তিনি ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’তেও পাঠিয়েছিলেন।

মন্দিরের ভিতরে অঞ্জনদা।

এপ্রিল মাসের ভরা দুপুরে আমরা দু’জন বাইকে চড়ে এগিয়ে চলেছি। আমাদের পাশে পাশে ভাগীরথীও বয়ে চলেছে। হঠাৎ আমার চোখ পড়ে রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে গাছগাছালি দিয়ে ঢাকা ইটের তৈরি একটি বিরাট আকারের জরাজীর্ণ স্থাপত্যে। দাদাকে দ্রুত বাইক থামাতে বলি। দাদা বাইক নিয়েই সেই পুরনো স্থাপত্যের দিকে এগোন। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে দেখা যায় পৌঁছনোর কোনও ভাল রাস্তা নেই। যেতে গিয়ে আমরা একটি বাড়ির উঠোনে এসে পড়ি। বাড়ির এক মহিলা আমাদের জানান, বাইক নিয়ে সেই জরাজীর্ণ স্থাপত্যে যাওয়া যাবে না। তিনি আমাদের একটা হাঁটা পথ দেখিয়ে দেন।

আমরা মহিলার নির্দেশ মতো একটি বাঁশঝাড়ের নীচে বাইক রেখে একটি দুর্গম রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম এবং কিছুটা যেতেই সেই ভাঙা স্থাপত্যে গিয়ে উঠলাম। বিশাল সেই স্থাপত্যটি কাছ থেকে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হল। কিন্তু এই স্থাপত্যটি দেখে প্রথমে আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে সেটি আসলে মসজিদ, মন্দির নাকি দরগা। স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসা করেও কোনও লাভ হল না। তাঁদের কেউ বললেন মন্দির। আবার কেউ বললেন মসজিদ।

রাস্তার পাশে নদী।

স্থাপত্যটি যে আসলে মসজিদ নয় তা বোঝা গেল ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু তখনও দু’টি সম্ভাবনার কথা মাথায় এল, হয় এটি মন্দির, না হলে দরগা হবে। গুগল ম্যাপে দেখাল দরগার অবস্থান আরও কিছুটা দূরে। ফলে এই বিরাট স্থাপত্যটিকে আমরা বিরাট মন্দির হিসেবেই ভাবতে থাকলাম। আসলে এই স্থাপত্যটির কারুকার্যের সঙ্গে ইসলামীয় স্থাপত্যেরও কিছুটা মিল ছিল। অবশ্য অমিলও ছিল অনেক।

সে দিন বাড়ি ফিরে এই স্থাপত্যটির খোঁজ করতেই দেখলাম আসলেই সেটি মন্দিরই। মন্দিরটির নাম ‘তুলসীবিহার মন্দির’। নসিপুরের রাজা উদবন্ত সিং নাকি এই এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। এটি ছিল একটি পঞ্চরত্ন মন্দির। কিন্তু এত সুন্দর মন্দিরটি সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের প্রহর গুনছে দেখেও কষ্ট হল। দেখলাম মন্দিরটি বর্তমানে স্থানীয় জনগণ তাঁদের ছাগল,গরু ও খড় রাখার কাজে ব্যবহার করছেন। এক প্রবীণা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, কোথা থেকে এসেছি, কেনই বা এসেছি? আমি মহিলার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, এই স্থাপত্যটি দেখতে কোনও মানুষ আসে কিনা? ভদ্রমহিলা বলেন, “অনেকেই আসে।” তিনি আরও জানান, এই গত কয়েক মাস আগেই নাকি কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসেছিল এই স্থাপত্যটির খোঁজ নিতে।

এবার সেই ভদ্রমহিলাটি আঙুল দিয়ে স্থাপত্যটির চারপাশের এলাকা নির্দেশ করে আমাদের জানান যে, মন্দিরটি নাকি এক সময় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সেই প্রাচীর তিনি তাঁর ছোটবেলাতেও দেখেছেন। দেখলাম, মন্দিরের একেবারে পিছনেই নদী বয়ে চলেছে। আমরা এবার নদীর কাছে গেলাম। নদী দেখতে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করলাম মাটির ভেতরে অসংখ্য পোড়া মাটির ভাঙা হাঁড়ির নিদর্শন। অবশ্য এসব আমাকে অবাক করেনি, পুরনো নগরীর ধ্বংসাবশেষে এসব থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আমরা ইতিমধ্যেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রমজান মাস চলছে, আমি রোজাও আছি। এবার এখান থেকে বেরোনোর পালা। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। তখনও আমাদের অনেক কিছুই দেখার বাকি।

এভাবেই পড়ে আছে স্থাপত্যের নির্দশন মন্দিরটি।

কিন্তু বাঁশতলার ঠান্ডা পরিবেশ ছেড়ে ভর দুপুরের তীব্র তাপে কোথাও বেরোতে শরীর সায় দিচ্ছে না। কিছুটা মনের বিরুদ্ধে গিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

কভারের ছবি— তুলসীবিহার মন্দির

ছবি— লেখক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *