সহ্যাদ্রি
পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

বর্ষার সহ্যাদ্রি- মহাবালেশ্বর

ডঃ শ্রাবনী চ্যাটার্জি

“হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সঙ্কেতে

ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ,

কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো আলো মাখা

ভুলেছি ভবিষ্যত’।

পঞ্চগনি থেকে মহাবালেশ্বর যাওয়ার রাস্তায় এই গানটাই আমার মাথায় ঘুর ঘুর করছিল। এমন ছায়া ছায়া জঙ্গলে ঢাকা রাস্তা, হঠাৎ ছুটে আসা মেঘের চাদর আর কুয়াশার আবছায়া হাতছানি। গাড়ির কাচে বৃষ্টির কণার আঁকিবুকি আর আবছা উপত্যকার সিল্যুয়েট। সহ্যাদ্রির রূপের মধ্যে এখানে অনেকখানি রহস্যময়তা মিশে। সেই জন্যই এর আকর্ষণ দুর্নিবার। আমি তো ভারতের ‘স্ট্রবেরি ক্যাপিটাল’ দেখতে বেরিয়েছিলাম। ছোট ছোট লতা গাছে থোকা থোকা সাদা ফুল আর টুকটুকে লাল ফল দেখব বলে। কিন্তু সহ্যাদ্রি আমাকে যে রূপ দেখাল, আহা! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।

স্থাপত্যের নিদর্শন।

মহাবালেশ্বর যেতে গেলে এক সাতারা স্টেশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে যেতে হয়। আর নইলে পঞ্চগনি অবধি বাসে এসে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়াও অন্য রুট হয়তো আছে। কিন্তু সে আমার জানা নেই। পঞ্চগনি থেকে মহাবালেশ্বর খুব দূরও নয়। ওই গোটা ২০ কিলোমিটার। আর পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপত্যকা বেয়ে সেই রাস্তাও ভারী মনোরম। পশ্চিমঘাট পর্বতের এই সর্বোচ্চ অংশে ব্রিটিশরা বোম্বাই প্রদেশের গ্রীষ্মাবাস বানিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য এখানে যাদবদের রাজত্ব ছিল। শিবাজী বিজাপুরের কাছ থেকে এই জায়গা দখল করে কাছেই প্রতাপগড় দুর্গ বানান। যেখানের রঙ্গমঞ্চে আফজাল খানের নাটকের যবনিকা পতন ঘটেছিল।

প্রতাপগড় দুর্গ।

মহাবালেশ্বরে থাকার অনেক হোটেল আছে। ম্যালের মতো জায়গাটায় অনেক রেস্তরাঁও আছে। আবার চাইলে পঞ্চগনিতে থেকেও দিনে দিনে মহাবালেশ্বর ঘুরে নেওয়া যায়। হাজার আড়াই খরচ করলে প্রতাপগড় আর মহাবালেশ্বর দেখা হয়ে যাবে।

আমরা রওনা হয়েছিলাম সাতসকালে। প্রথম গন্তব্য প্রতাপগড় দুর্গ। দুর্গের মুখে গাড়ি থেকে নেমে গাইড সঙ্গে নিয়ে হাঁটা লাগাতে হয়। সবশুদ্ধ ৪৫০ সিঁড়ি চড়লে দুর্গ দেখা কমপ্লিট। এখনও দুর্গে অনেক পরিবার বাস করে। তাঁরা নাকি শিবাজীর সৈনিকদের বংশধর। দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁরাই করেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মাঝখানে পরে মা ভবানীর মন্দির। সেখানে কালো কষ্টিপাথরে শিবাজীর আরাধ্যা দেবীর মূর্তি আর ক্রিস্টালের শিবলিঙ্গ। মন্দিরের বাইরে সেকালের কিছু অস্ত্রশস্ত্র রাখা। আরেকটু উপরে শিবমন্দির আর তার সামনের জায়গায় নাকি রাজসভা ছিল। শিবাজীর বাসস্থান যেখানে ছিল সেখানে এখন আর কিছুই নেই, ভিতটুকু ছাড়া। সরকার থেকে শিবাজীর মূর্তি তৈরি করিয়ে দিয়েছে। গোটা চত্বরটাই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুর্গ ঢোকার মুখেই উল্টোদিকের পাহাড়ে আফজাল খানের সাদা সমাধি দেখা যায়। খালি চোখেই নজরে পরে, দূরবীণ লাগে না।

আফজল খাঁয়ের সমাধি।

সে সব দেখে আর অত সিঁড়ি ভেঙে বেজায় খিদে পেয়ে গেলে মহাবালেশ্বর ঢুকেই আগে খেয়ে নিতে হবে। বলেইছি এখানে ম্যালের মতো একটা জায়গায় অনেক দোকানপাঠ আছে। সেখানে জলখাবার খেয়ে আর নানারকমের বেরি ফল কিনে থলিতে ভরে ভেন্না লেক চলে যাওয়া যায়। মহাবালেশ্বর স্ট্রবেরির জন্য বিখ্যাত। গোটা ভারতের মোট স্ট্রবেরি উৎপাদনের ৮০ শতাংশ এখানে হয়। তার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বেরি এবং ফলজাত দ্রব্যও মহাবালেশ্বরে বিখ্যাত। অসময়ে গেলেও স্ট্রবেরি বাগানে কিছু ফুল ফল দেখতে পেয়েই যাবেন। আর পাবেন দুর্দান্ত স্বাদের স্ট্রবেরি ক্রিম আর স্ট্রবেরি ক্রাশ।

ভেন্না হ্রদ।

মহাবালেশ্বরে ঘোরার জায়গার মধ্যে চারিদিকে পাহাড় ঘেরা ভেন্না হ্রদ তো আছেই। আর আছে সাবিত্রী পয়েন্ট, আর্থার পয়েন্ট, কেট পয়েন্ট, লিঙ্গমালা জলপ্রপাত এবং হাতির মাথার মতো দেখতে সেই প্রাকৃতিক পাথর খণ্ড যাকে ‘নিডল হোল রক’ বলে। ওই পাথরের ছবি অনেকেই অনেক পর্যটনের বিজ্ঞাপনে নিশ্চয় দেখেছেন। কিন্তু জায়গাটা চেনেন না।

হাতির মাথার মতো পাহাড়।

পুরনো মহাবালেশ্বরের চরিত্র আবার একদমই অন্যরকম। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তীর্থস্থান। যাদব রাজারা এখানে বানিয়েছিলেন পঞ্চগঙ্গা মন্দির। যা পাঁচটি নদীর উৎসস্থল। পাঁচটি নদী হল- কৃষ্ণা, ভেন্না, কয়না, সাবিত্রী এবং গায়ত্রী। এ ছাড়াও আছে শতাব্দী প্রাচীন কৃষ্ণা নদীর মন্দির। যা এখন সংরক্ষিত প্রত্নস্থল। তবে মহাবালেশ্বরের সব থেকে জনপ্রিয় তীর্থস্থান হল মহাবালেশ্বর শিবের মন্দির। প্রতি বছর বহু তীর্থযাত্রীর সমাগম হয় মহাদেবের দর্শনে।

বর্ষায় প্রকৃতির রূপ।

প্রাচীন মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ ছুটে আসে এলোমেলো মেঘ। ঢেকে দেয় দৃশ্যমান চরাচর। তার পর দিগ্বিদিক মাতিয়ে আমাদের ভিজিয়ে নামে অঝোর ধারা-শ্রাবণ। রিমঝিম্ ঘন ঘন রে বরষে।

প্রকৃতির মাঝে দোঁহে।

ছবি— লেখিকা

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *