কালো পুতুল।
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কুমোরপাড়ার গল্পস্বল্প— কালো পুতুলের পাড়া

দীপক দাস

উপড়ুনি মাটির কথা শুনিনি কখনও। এ মাটি আবার বিক্রি হয়। ৮০ টাকা কিলো। সামসের আলি বিক্রি করছিলেন। ঘাটালের চন্দ্রকোনা থেকে এসেছিলেন মাটি বিক্রি করতে। উপড়ুনি মাটি লাগে কুমোরপাড়ায়। মাটির জিনিসপত্র রোদে শুকিয়ে পুড়িয়ে নেওয়ার আগে এলামাটির প্রলেপ লাগিয়ে নিতে হয়। তার উপরে পড়ে উপড়ুনি মাটির প্রলেপ। তবেই ভাল মতো পুড়ে মাটির জিনিসপত্র লাল রং ধরে।

গিয়েছিলাম উদয়নারায়ণপুরের সিংটিতে। আমাদের হাওড়া জেলার পুতুলপাড়াগুলোয় ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে। একবার সিংটির বিখ্যাত ভাই খাঁ পিরের মেলা দেখতে এসেছিলাম আমরা। ইন্দ্র, দীপু আর আমি। মেলায় ঢেলে বিক্রি হচ্ছিল মাটির জিনিসপত্র। সে দিন তাড়া ছিল। ফলে ভাল করে খোঁজ নেওয়া হয়নি। নরেন্দ্রপুর কুমোরপাড়ায় বারবার সিংটির নাম শুনেছিলাম। সিংটি থেকে মাটির জিনিসপত্র কিনে নরেন্দ্রপুরের লোকজন বিক্রি করেন। ফলে একদিন অভিযান। এ বারের অভিযানে সঙ্গী শুধু দীপু। আমাদের দীপশেখর দাস। যিনি এখন ঘাসপুসের ডক্টর হয়েছেন। মানে ওর বটানিতে পিএইচডি ডিগ্রি হাসিল হয়েছে।

উপড়ুনি মাটি বিক্রি করছেন সামসের আলি।

এলাকায় ঢোকার আগে ভাল মৃৎশিল্পীর খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। পাওয়া গিয়েছিল সুকুমার পালের নাম। তাঁর পণের কাছেই উপড়ুনি মাটি বিক্রি করছিলেন সামসের। উপড়ুনি মাটিটা কী? সুকুমারবাবু ও সামসেরের কথায় যেটা বোঝা গেল, যেখানে ঝরনার জল ধেয়ে আসে সেখানে হলুদ মতো আস্তরণ ফেলে। এই হলুদ মাটি সংগ্রহ করা হয়। এই মাটিই উপড়ুনি। রংটা কাঠ পালিশের মতো। তবে নদীর প্রভাবেও এরকম মাটি জমে। সিংটির কাছে ছিল দামোদরের স্রোত। সেখানেও এরকম মাটি মিলত। হাওড়ার পুরাশ কানপুরে এরকম মাটি পাওয়া যায়। আগে জগৎবল্লভপুরের কাছে ইছানগরীতেও উপড়ুনি মাটি বিক্রি হত প্রচুর। ওখানে টালি কারখানা ছিল। টালি পোড়াতেও উপড়ুনি মাটি লাগে। এখানে কৌশিকী তথা কানা দামোদরের একটা স্রোত এখনও রয়েছে। তবে কারখানা বন্ধ হয়েছে। উপড়ুনি মাটি বিক্রিও বন্ধ। মাটি বৃষ্টির জলে গুলতে হয়। তার পর মাটির পাত্রে প্রলেপ দেওয়া।

রোদে শুকোচ্ছে সুকুমার ও সুষমা পালের তৈরি মাটির জিনিসপত্র

এ বার কুমোরপাড়ার গল্পে ফেরা যাক। সিংটি কুমোরপাড়া বেশ বড়সড়। সুকুমারবাবুর বাবারাই ছয় ভাই ছিলেন। চারজন মাটির কাজ করতেন। সুকুমারবাবু ও তাঁর স্ত্রী সুষমা নিয়মিত মাটির কাজ করেন। এটাই তাঁদের পেশা। এই দম্পতির জিনিসের সুনাম রয়েছে। সুকুমারবাবুরা কলসি করেন তিন চার রকম। ভাতের হাঁড়ি পাঁচ-ছ’রকম। মাটির জিনিসের চল কমছে বলেই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে জানা গিয়েছে। পালা পার্বণে মাটির জিনিসের চাহিদা হয়। তা সত্ত্বেও পাঁচ-ছ’রকম ভাতের হাঁড়ি। এঁরা আশ্চর্যজনক তথ্য দিলেন। জানালেন, এখনও বহু বাড়িতে মাটির হাঁড়িতে ভাত হয়। পুজোয় মাটির ১৩ রকম জিনিস লাগে। স্বামী-স্ত্রী মিলে সে সব তৈরি করেন। মাটির জিনিসে তাঁরা রং করে দেন না।

সুকুমারবাবুদের চাক।

সুষমা পালের বাপের বাড়িতেও মাটির কাজ ছিল। বাপের বাড়ি হুগলির রামচন্দ্রপুরে। রাজবলহাটের কাছে। তবে তাঁর বাবা মাটির কাজ করতেন না। করতেন ঠাকুরদা আর জেঠু। পরে দাদা। ২৭ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল সুষমা পালের। তিনিও বহু রকম কাজ জানেন। আমাদের চেনাচ্ছিলেন মাটির জিনিস তৈরির নানা উপকরণ। জানালেন, হাঁড়ি, কলসির উপরের অংশ তৈরি হয় চাকে। পাত্রগুলোর মুখের কাছে যে ভাঁজ থাকে তা তৈরি হয় চাকের ঘুর্ণনে আর হাতের আঙুলের কৌশলে। নীচের অংশটা তৈরি হয় চাপড়ে। এই অংশ তৈরি করতে দু’টো কাঠের যন্ত্র লাগে। একটা পিন্দে, অনেকটা ছোটখাট ক্রিকেট ব্যাটের মতো দেখতে। আরেকটা গোলে। মাটির তৈরি নিরেট কোনও বল আধখানা কেটে নিলে যে আকার হয় গোলে সে রকম। পরে চাক আর চাপড়ে তৈরি করা অংশ দু’টো জল-মাটি দিয়ে জুড়ে নেওয়া হয়।

পিন্দে আর গোলে।

মাটির কাজে সমস্যা আছে কোনও? সুকুমারবাবু জানালেন, প্রচুর খাটুনি। বিক্রিবাটা অনেক কমে গিয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্ম আর কেউ এ কাজে আসতে চাইছে না। তাঁদের ছেলেই আগ্রহ নন এ কাজে। তাঁদের পাড়ায় গোটা ছ’ঘর এখন মাটির কাজ করেন। সুকুমারবাবুর কাজের সুনাম রয়েছে। ফলে লোকে তাঁর পণ থেকেই পাইকারি নিয়ে যান। আগে পাতিহাল, নরেন্দ্রপুরে জিনিসপত্র দিতেন। কিন্তু এখন শুধু নরেন্দ্রপুরে মাল যায়।

পিন্দে দিয়ে কাজ করছেন সুষমা পাল।

মাটির কাজে সরকারি ঋণ পাওয়া যায় না। সেই ১৯৮০ সাল নাগাদ একবার ঋণ পেয়েছিলেন ৮০০ টাকা। পুরনো পদ্ধতির চাক বেশ ভারী। জায়গাও লাগে অনেকটা। সরকারের তরফে যন্ত্রচালিত চাকের ব্যবস্থাও করা হয় না। তবে সুষমা পাল জানালেন, তাঁর দাদাকে সরকার থেকে চাক দিয়েছিল। তা হাতে এবং যন্ত্রে চালানো যেত। তবে তা আগের সরকারের আমলে।

সুষমা পাল চাপড়ে তৈরি করছেন জিনিসপত্র।

অন্য কুমোরপাড়ায় দেখেছি, মাটি একটা বড় সমস্যা। এটা সিংটির কুমোরপাড়ায় নেই। তাঁরা সরকারি কোনও পুকুর কাটানো হলে সেখান থেকে মাটি কিনে নেন। বাইরে থেকে মাটি এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। তা ছাড়া দামোদর নদের শাখা বইত এই এলাকা দিয়ে। এখনও কোনও কোনও জায়গায় মাটির গভীর থেকে কালো মাটি মেলে।

মাটির কাজের জন্য সুকুমারবাবু সম্মানিতও হয়েছিলেন। উদয়নারায়ণপুরের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তাঁকে সম্মানিত করে। কুমোরপাড়ায় তো পুতুল তৈরি হয়! তাঁরা তৈরি করেন না? আগে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পুতুল তৈরি করতেন। এখন তেমন সুযোগ মেলে না। কাজের চাপ থাকে। তবে এ পাড়ায় পুতুল তৈরি হয়। জানালেন তিনি। খোঁজ নিতে বললেন মোহন পালের।

কাজে মগ্ন সুকুমার পাল।

পাড়ায় ঢোকার মুখে রাস্তার কাছেই বাড়ি মোহন পালের। বয়স ৭০ বছর। এখনও চাকের কাজ করেন। ছেলেরা মাটির কাজ করেন না। তবে চাক ঘুরিয়ে দেন। তাতেই অল্পস্বল্প ভোগের মালসা, হাঁড়ি ইত্যাদি তৈরি করেন। মাটির জোগান রয়েছে। এক কিলোমিটার দূরেই একটা পুকুর আছে। গরম কালে জল শুকিয়ে গেলে নিজেদের খরচায় মাটি তুলে নিতে পারেন পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। অন্য জায়গা থেকেও কেনা হয় মাটি।

মোহন পাল আর অসীমা পাল।

মাটির জিনিসপত্রের সঙ্গে কুমোরদের পুতুলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মোহনবাবুরা। তাঁর স্ত্রী অসীমা পাল পুতুল তৈরি করেন। এ ছাড়াও বাচ্চাদের জন্য নানা জিনিসপত্র, পালকি তৈরি করেন। আর তৈরি করেন বোকা ভাঁড়। ভাল কথায় বললে, লক্ষ্মীর ভান্ডার। সিংটির পুতুলের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে চিরাচরিত পোড়া মাটির স্বাভাবিক রঙের পুতুল পাওয়া যায়। ছেলে পুতুল, মেয়ে পুতুল। এগুলো পাওয়া যায় কালো রঙেরও। বিশেষ পদ্ধতিতে পুড়িয়ে তৈরি হয় কালো পুতুল। সেই পদ্ধতি বললেন অসীমা পাল। পণে অন্য জিনিসপত্রের সঙ্গেই পুতুলও পোড়ানো হয়। যে পুতুলগুলো কালো করা দরকার সেগুলো রাখা হয় হাঁড়ির মধ্যে। তাতে দেওয়া হয় ঘুঁটে, শুকনো আমপাতা। তার পর হাঁড়ির মুখটা কাদা দিয়ে বায়ুনিরুদ্ধ করে আটকে পণে দেওয়া হয়। আমপাতা, ঘুঁটের ধোঁয়া বাইরে বেরোতে পারে না। পুতুলের রং কালো করে দেয়।

অসীমা পালের তৈরি পুতুল।

সিংটি সুন্দর মাটির কাজের পাড়া। এখান থেকে জিনিসপত্র গিয়ে হাওড়ার বিভিন্ন কুমোরপাড়ার ব্যবসা বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু কত দিন ধরে রাখবে? দু’একজনের ব্যবসা হয়তো টিকে থাকবে। কিন্তু বহু পরিবারই ধীরে ধীরে মাটির কাজ ছাড়বে। ইতিমধ্যেই ছাড়তে শুরু করেছে। মোহন ও অসীমা পালের সঙ্গে কথা বলার সময়ে ছিলেন সঞ্জীব পাল। পাশেই বাড়ি। তাঁর বাড়িতেও আগে মাটির কাজ হত। এখন কেউ করেন না। সঞ্জীবও বলছিলেন, মোহন ও অসীমা পালেদের প্রজন্মের পরে পুতুলের ঐতিহ্য হয়তো শেষ হয়ে যাবে।

ছবি- দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *