দীপক দাস
লাট্টু পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছিল বাড়িটা। বাংলো বলাই ভাল। বাড়ি বললে মান কমবে। লাল রংয়ের বাড়িটা দেখে দীপু বারবার বলছিল, ‘‘এই বাড়িটায় ‘ভালবাসা ভালবাসা’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল।’’ তা হতেই পারে। আমরা এসেছি যে এককালের এক বিখ্যাত শ্যুটিং স্পটে। ঠিক শ্যুটিং স্পট নয়। সর্বাগ্রে রাখতে হবে সৌন্দর্য। তার পর সেই সৌন্দর্য আর জলহাওয়ার টানে আসা বাঙালি। শেষে বাঙালি ছবি করিয়েদের আগমন।
দুর্গাপুজোর অষ্টমী। ‘চারমূর্তি’ পা রেখেছি শিমুলতলায়। সরাসরি নয়। ভাঙা-সফরে। হাওড়া স্টেশন থেকে গভীর রাতে বর্ধমান লোকাল হয়ে ছেড়ে ধীরে ধীরে ‘ভারত ভ্রমণের’ দিকে অগ্রসর হওয়ার মনোবাঞ্ছা রাখা ট্রেনে। সে ট্রেন যাত্রার কথা মধুপুর পর্বে বলা হয়েছে। মধুপুরে এক রাত কাটিয়ে পরদিন চলে এসেছি শিমুলতলায়। আর সেই বিখ্যাত ট্রেনেই। যে শুধু টেনে টেনে তার গন্তব্য বাড়িয়ে চলে। সকালের দিকে মধুপুর থেকে আর কোনও ট্রেন ছিল না। আমরা দেখলাম, ট্রেনটা তার স্বধর্ম বজায় রাখল। আমরা মধুপুর যখন চাপলাম তখন ছিল জসিডি মেমু। জসিডিতে গিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ট্রেন হয়ে গেল ঝাঁঝা মেমু। ঝাঁঝায় গিয়ে কী মেমু হত জানি না। জানার গরজ ছিল না। ট্রেন থেকে দু’পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে টুক করে নেমে পড়েছিলাম শিমুলতলায়। বাঙালির আরেক খ্যাতনামা পশ্চিমে।
কটোরবা পুলের কাছে। দূরে আমাদের রথ।
রহস্য গল্প পড়ে একটা শিক্ষা হয়েছে। অভিযানে বেরোলে ফিরে আসার পথটা জেনে রাখতে হয়। আমরাও শিমুলতলা স্টেশনে নেমে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে নিলাম। জিজ্ঞাসা করছিলাম এক আরপিএফ কনস্টেবলকে। তিনি ঘোরাঘুরির গাড়ি, এলাকা, সময় ইত্যাদি জানালেন। আমরা হাওড়া ফিরব মোকামা এক্সপ্রেসে। শিমুলতলায় ৭টা নাগাদ আসবে। তার মধ্যে সব ঘোরা হয়ে যাবে তো! কনস্টেবল ভদ্রলোক জানালেন, মোকামা প্রচুল দেরি করে। ৯টা লেখা থাকলেও রাত ১০টা বেজে যাবে। শুনেই ইন্দ্রর দিকে তাকালাম। ও মধুপুরের ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ফেরার ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলেছিল। পরে দীপু দেখেছে, জসিডি থেকে অনেক ট্রেন। স্টেশনে ঘণ্টা তিনেক বসে থাকতে হবে! ইন্দ্র বোধহয় রহস্য গল্প বেশি পড়েছে।
কটোরবা পুল পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তা।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটু জলযোগের সন্ধান করছিলাম। কিন্তু মিষ্টির দোকানে পাঁজা পাঁজা বালুশাহি আর গজা। আর কিছু মিলল না। এক দোকানদার জানালেন, ১১টা বেজে গিয়েছে। আর কিছু মিলবে না। ছোট বাজার। মাপের তৈরি হয় বোধহয়। অগত্যা আমাদের ইন্দ্রবাবুর আনা ঘরে তৈরি মশলা চিড়ে আর রেশন ভরসা। স্টেশন চত্বরে ফিরে একটা অটো ভাড়া করে নিলাম। পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবেন। ভাড়া ৭০০ টাকা। অটোচালকের নাম লালু মাহাতো বয়স ২৩-২৪ বছরের মধ্যে। তাঁকে বলা হয়েছিল, রাস্তায় যদি কোনও খাবারের দোকান থাকে গাড়ি দাঁড় করাতে। কিন্তু মিলল না কিছুই।
আমাদের প্রথম গন্তব্য হল কটোরবা পুল। জঙ্গলে ঘেরা ভারী সুন্দর জায়গা। একদিকে জঙ্গল মাথায় করে দাঁড়িয়ে নাতি উচ্চ পাহাড়। আরেক দিকে রেললাইন। পাকা সড়কের মাঝে একটা পুল। একটা ঝরনা বয়ে চলেছে তার নীচ দিয়ে। এটাই কটোরবা পুল। জলধারা রেলপুলের নীচের দিকেও বয়ে গিয়েছে। পাহাড় থেকে ঝরনার জন্ম। লালু জানালেন, এখানে স্থানীয় ভাবে ঝোরি বলে। এখানে নাকি কোনও এক সময়ে শ্যুটিং হয়েছিল। তবে কবে, কোন সিনেমার সে সব কিছু বলতে পারেননি।
ধারারা যাওয়ার পথে।
জায়গাটা বেশ ভাল লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ ছবি তোলা হল। আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হল। এই রাস্তা ধরে এগোলে খুরান্ডা গাঁও, ঘরপাহারান, লারগঞ্জ নামে জায়গাগুলো পড়বে। আমরা অটো এগিয়ে নিয়ে যেতে বললাম। যেখানটা ভাল লাগবে দাঁড় করিয়ে নেমে যাব। কিছুটা যাওয়ার পরে একটা জায়গা পছন্দও হল। জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে। কটোরবা পুলের কাছে রেললাইনটা দূরে। এখানে কাছে। দু’দিকেই জঙ্গল। আমরা রেললাইনের উল্টো দিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। রাস্তা থেকে অনেকটা দূরেই ঢুকেছিলাম। তবে ওই পর্যন্ত লোকজন ঢোকেন। তার প্রমাণ রয়েছে।
দীর্ঘক্ষণ জঙ্গলে ছবি তোলা হল। আমাদের ঘাসপুসের ডক্টর দীপু নানা গাছের ছবি তুলছিল। আমাদের চেনাচ্ছিল। তবে গাছের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। আমাদের আমোদের স্মৃতিতে তা ঢাকা পড়ে যাবে।
ধারারা ঝরনা।
জঙ্গল থেকে আবার ফিরলাম স্টেশনের কাছে বাজারে। সকালে খাওয়া হয়নি ভাল। বাজার ছাড়িয়ে একটা মাটির ঘরের সামনে অটো দাঁড় করালেন লালু। এটাই হোটেল। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে। এলাকা সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। আমি বলছিলাম, ‘‘আরেকটু এগিয়ে আর কোনও হোটেল নেই?’’ কথাটা ‘দিল পে’ নিয়ে ফেললেন হোটেলের মালিক কাম রাঁধুনি। বলে উঠলেন, ‘‘ঝোপড়ার হোটেলে খেয়েই দেখুন না।’’ বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ওটা কোনও ব্যাপার নয়। আমরা এরকম বহু জায়গায় খেয়েছি। অটোচালক লালু, মুষ্ঠবদ্ধ হাতের ইশারা এবং মুখে হুমকি দিয়ে গেল, ‘‘খাবার ভাল না হলে…!’’
এবার গন্তব্য ধারারা ঝরনা। মাটির হোটেলটা ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই পাঁচিল ঘেরা একটা বাগানওয়ালা বাড়ি পড়ল। বাংলো বাড়ির মতো। বাড়ির হাতায় অনেকখানি জায়গা। কোনও বাঙালির হবে। বাংলা নামফলকের একটা বাড়ি দীপু আর বাবলা স্টেশনের কাছের বাজারে দেখেছে। কমলা কুটির। তৈরি হয়েছিল ১৩২০ বঙ্গাব্দে। ১২১ বছর আগের তৈরি। বাঙালি মালিক কলকাতায় থাকেন। তবে বছরে কয়েকবার আসেন। বাড়ি দেখাশোনা করেন কেয়ারটেকার।
ধারারার আরেক দিক।
দূরে গাছপালা, ধান খেত টিলা। রাস্তার পাশে ছোট ছোট পাড়া পেরিয়ে অটো এগোচ্ছে। কোথাও রাস্তার উপরে ভুট্টা ছাড়িয়ে শুকনো করতে রাখা। রাখা আছে ভুট্টার আধার গদার মতো অংশটাও। ওটা শুকিয়ে জ্বালানি হবে। দানাগুলো খাওয়ার জন্য। কোথাও বাচ্চাগুলো বাড়ির সামনে দল বেঁধে খেলছে। কোথাও তোলা জলে বাসন মাজা চলছে। এখানে জলের নিশ্চয় অভাব। যেতে যেতে তোলা ছবিতে দু’টো গ্রামের নাম উঠে গিয়েছিল। চাঁদবাড়ি আর কেন্দুহারা।
টুকরো টুকরো গ্রামছবি দেখতে দেখতে ধারারা পৌঁছে গেলাম। টিলার উপরে একটা মন্দির। লোকজন আসছে। ঝরনাটা নীচে। টিলা থেকে একটা সিঁড়ি করে দেওয়া রয়েছে। দীপু আর বাবলা নেমে গেল। আমার পায়ের পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দিয়েছে। গোড়ালি বন্ধনীটা পরে নিয়ে ধীরে ধীরে নামলাম। ওরা তখন পাথর বেয়ে বেয়ে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। আমি আর ইন্দ্র বেশি দূর গেলাম না। একটা পাথরের উপর বসে চিড়ে ভাজা খেতে খেতে চারদিকটা দেখতে থাকলাম। একটা ক্যারিব্যাগে চিড়ে লালুকেও দিয়ে এসেছি।
ধারারার বুকে।
এখানকার প্রকৃতিটা কী ভাবে সৃষ্টি হয়েছে? দু’জনে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ঝরনাটা বইতে বইতেই কি পাথরগুলোর ক্ষয় হয়েছে? তাতেই কি এত ক্ষতবিক্ষত রূপ? নাকি কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় কারণ? অক্টোবর মাসে ঝরনাটা অনেকটা শীর্ণ। কিন্তু বর্ষাকালে বোধহয় আরও বড় চেহারা নেয়। আমরা প্রায় পাড়ের দিকে বসে আছি। এখানেও পাথরের খোদলে খোদলে জল জমে আছে। দূরে ঝরনায় চান করতে করতে হুল্লোড় করছে অনেকজন। স্থানীয় বোধহয়।
ফটোসেশন শেষ করে বাবলা আর দীপু এল। আমরা উঠতে শুরু করলাম। ঝরনাটা বাঁদিক থেকে এদিকে নেমে এসেছে। সেই দিকটা একবার দেখা দরকার। আবার চড়াই। টিলার উপরে উঠতে দেখা গেল ঝরনাটাকে। উপরের দিকে শান্ত। একটু পথ পেরিয়ে নীচে দিকে বেশ বেগবান।
প্রকৃতির নানা শিল্পকর্ম।
অটোর কাছে যখন ফিরে এলাম তখন লালু ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডেকে তোলা হল। এখানকার রাস্তা কয়েক জায়গায় সুবিধের নয়। যাওয়ার সময়ে দূরে একটা নদী দেখতে পেয়েছিলাম। ফেরার পথে থামা হবে কথা ছিল। সেই মতো নামা হল। গরু চরাচ্ছিলেন এক ঠাকুমা আর নাতনি। তাঁদের কাছে গ্রামের নাম, নদীর নাম জানতে চাওয়া হয়েছিল। কী বলছিলেন বোঝা যাচ্ছিল না। স্টেশন চত্বরের দোকান বাজারের মানুষগুলোর হিন্দি বোঝা যাচ্ছিল। আমাদের বাংলা ব্যাকরণ ও উচ্চারণে বলা হিন্দিও ওঁরা বুঝতে পারছিলেন। কেউ কেউ বাংলাও বলতে পারেন। কিন্তু একেবারে ভিতরের দিকে ভাষা বোঝা যাচ্ছে না। লালুর ভাষাও বুঝতে পারছি না। বোধহয় ভোজপুরী বলছেন। আমাদের সরল হিন্দিও দু’তিনবার করে বোঝাতে হচ্ছে ওঁকে। ফলে লালুর মুখের উচ্চারণে জায়গার নামগুলোয় আমাদের বোঝার ভুল হতেই পারে।
মন্দির থেকে ধারারার গর্ভে নেমে আসার পথ।
ঠাকুমার কথা দু’তিনবার শুনে আন্দাজ করলাম নদীটার নাম করুয়া। আর গ্রামের নাম খারপা। পাশে আছে চম্পা। নদীটা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে। শীর্ণকায়া। শরীর জুড়ে বালির ভূমি। দূরে বাচ্চারা নদীর বুকে কী যেন করছে। বোধহয় মাছ ধরছে। ঠাকুমা বলছিলেন, নদীতে নাকি মাছ নেই। এই করুয়াই ধারারার দিকে গিয়েছে বা এসেছে।
লালু আমাদের করুয়ার কাছ থেকে নিয়ে গেলেন একটা জায়গায়। রামকৃষ্ণ মঠ বলে জায়গাটিকে। পাঁচিল ঘেরা অনেকটা জায়গা। কিন্তু কেউ থাকে বলে মনে হল না। পাঁচিলের বাইরে ছোট্ট একটা ঘরে বিবেকানন্দ একলা দাঁড়িয়ে।
করুয়া নদী।
বেশি না কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অটো গিয়ে থামল খাড়া একটা পাহাড়ের নীচে। এটাই লাট্টু পাহাড়। পাহাড়ের একদিকে ভাঙাচোরা একটা প্রাসাদ। এই প্রাসাদ শিমুলতলার পরিচয়-চিহ্ন। কোনও এক রাজা বা জমিদারের থেকে বেশি বড় কেউ এটা বানিয়েছিলেন তাঁর রানির জন্য। লাট্টু পাহাড়ের উপর থেকে ওই পরিত্যক্ত প্রাসাদ, উঁচু নীচু উপত্যকা, পিছনের পাহাড়ের সারি আর পাশে একটা জলাশয় মিলে অপূর্ব দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে। প্রকৃতি যে একজন নিপুণ শিল্পী সেটা লাট্টু পাহাড়ের উপর থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছিল।
রামকৃষ্ণ মঠ।
চুড়োয় ওঠার কষ্টটা লাঘব হয়ে গেল ছোটা ডন বাবলার কীর্তিতে। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ উবু হয়ে বসে পড়ল বাবলা। তার পর উবু হয়েই সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। আমরা হেসে কুটোপাটি। লাট্টু পাহাড়ের চুড়োতেও একটা মন্দির রয়েছে। লৌকিক কোনও দেবতা বা দেবী। জিজ্ঞাসা করার লোক নেই কে ইনি? চুড়োর সব পাহাড়ে সিঁদুর মাখানো। আজ অষ্টমী। বোধহয় বলি হয়েছে। রক্তের দাগ বিভিন্ন পাথরে। বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিল না। পাহাড় থেকে নামার সময়েই চোখে পড়ল সেই বাড়িটা। যেটা দেখে দীপু বারবার বলছিল, এই বাড়িতেই বোধহয় ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল।
লাট্টু পাহাড়।
শিমুলতলায় অনেক সিনেমারই শ্যুটিং হয়েছিল। যেমন ‘দাদার কীর্তি’। তাপস পালের প্রথম সিনেমা। এই সিনেমায় সরাসরি শিমুলতলা নেই। স্টেশনে শ্যুটিং হলেও নাম দেখানো হয়নি। ফেল করার পরে তাপস পালকে পশ্চিমে পাঠানো হয়েছিল। তবে টাইটেল কার্ডে কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে অনেক নামের সঙ্গে শিমুলতলা অধিবাসীবৃন্দের উল্লেখ রয়েছে। ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ সিনেমায় কিন্তু শিমুলতলা সরাসরি রয়েছে। স্টেশনের নামফলক এবং টাইটেল কার্ডে। এই সিনেমায় দেবকীদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও দশরথ সিংয়ের নামের পাশে বন্ধনীতে শিমুলতলার উল্লেখ রয়েছে। এক দশরথ সিংয়ের নাম কিন্তু ‘দাদার কীর্তি’র টাইটেল কার্ডেও রয়েছে।
আমাদের আরেকটা জায়গা দেখাবে বলছিলেন লালু, গোলাপ বাগান। তার পাশ দিয়েই এলাম। গোলাপ গাছ এখন শুকনো দশায়। বাড়িটার নাম দেখে নিলাম। পাল ভিলা। এই ভিলার উল্টো দিকেও একটা বাংলো বাড়ি। এই পথ পেরিয়েই উঠলাম সেই ঝোপড়া হোটেলে। খেয়েদেয়ে লালুকে ছেড়ে দিয়ে সাড়ে ৪টের মধ্যে স্টেশনের চেয়ারে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
লাট্টু পাহাড় থেকে উপত্যকা।
কী করা যায়? লোকজন বেশি পাইনি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। একসময়ের বাঙালির উপনিবেশের বিষয়ে কিছু জানাই হয়নি। এদিকে সময়ও কাটছে না। স্টেশনের পাশেই দুর্গাপুজো হচ্ছে। বেশ বড়সড় পুজো। মণ্ডপের সামনে বোঁদে প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে। ভিন রাজ্যের দুর্গার ছবি তুলতে গেলাম। দর্শনার্থী প্রচুর অবাঙালি। দেখে এসে বোঁদে নিলাম। আসল উদ্দেশ্য ভাব জমিয়ে একটু এলাকার কথা জানা। যে দু’জন ছিলেন তাঁদের পদবি সিং। কিন্তু ভাল বাংলা বলতে পারেন। এ কথা বলতে, ওঁরা জানালেন, এখানকার লোক কম বেশি বাংলা জানেন। অটোচালক লালুর ভাষা নিয়ে আমাদের যে অসুবিধে হয়েছিল সেটা বললাম। ওঁরা জানালেন, তা হলে বোধহয় বাইরের অটো।
দুই সিংয়ের কাছে শিমুলতলার খোঁজ নেওয়া গেল। এখানে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির বাংলো ছিল একসময়ে। মার্টিন রেলের মালিক আর এন মুখার্জির বাড়ি ছিল এখানে। পাল ভিলার উল্টো দিকে। স্টেশনের কাছে রেলপুকুরের কাছে ছিল লর্ড সিনহার বাড়ি। এঁর নামে কলকাতায় রাস্তা রয়েছে। নিউ থিয়েটার্সের প্রতিষ্ঠাতা বি এন সরকারের বাড়ি নাকি এখনও আছে। সেটি স্টেশনের আরেকদিকে। সামনের সপ্তাহেই নাকি তাঁর নাতনি আসবেন। বিচারপতি তথা প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেনের বাড়িও ছিল এখানে। বাড়িটা লাট্টু পাহাড় থেকে দেখা যায়। দীপু হয়তো এই বাড়িটার কথাই বলছিল।
তবে শিমুলতলায় বাঙালির সেই রমরমা আর নেই। বেশির ভাগই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বিক্রি হয়ে গিয়েছে শ্যামল সেনের বাড়িও। তবে পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে এখনও। এখানে রিসর্টের বিজ্ঞাপন দেখেছি। একটা দোকানে গরম রসগোল্লা কিনতে গিয়েছিলাম। দোকানদার জানালেন, পাল ভিলাও রিসর্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা এসে যখন খাবার খুঁজছিলাম তখনও একটা গাড়িতে একটা দলকে যেতে দেখেছি।
স্টেশনের পাশের দুর্গাপুজো।
বাঙালির পশ্চিম বলে যে সুখ্যাতি ছিল তা বোধহয় এখন আর নেই। রয়ে গিয়েছে বাড়িগুলো। আর রয়েছে স্টেশনের সামনের দুর্গাপুজোটা। প্রসাদ বিতরণকারী দুই সিং বলছিলেন, পুজো শুরু হয়েছিল স্বাধীনতারও আগে। শিমুলতলার বাঙালি কোনও স্টেশন মাস্টার নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হলে পুজো শুরু করবেন, এমন মানত করেন। স্টেশন মাস্টারের নামটা মনে করতে পারছিলেন না সিংয়েরা। অনেক কষ্টে মনে করে বললেন, এস কে সিংহ। ঠিক মনে করেছিলেন কিনা জানি না।
এখন পুজো করে একটি কমিটি। অষ্টমীর সন্ধ্যায় এক বাঙালির শুরু করা পুজোয় লোকজনের আনাগোনা দেখতে দেখতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম চারজনে।
কভারের ছবি— লাট্টু পাহাড় থেকে
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)