দীপক দাস

দুই যুগের দুই কীর্তিশালী। তাঁদের স্মৃতিতীর্থে একই দিনে! পরিকল্পনায় ছিল না এমনটা। কিন্তু হয়ে গেল আচমকাই। গিয়েছিলাম হুগলির বনমালীপুরে। বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পৈতৃক ভিটায়। তাঁর পরিবারের শাখা এবং প্রশাখা এখনও এই গ্রামে রয়েছে। বিদ্যাসাগরের পরিবারেরই এক সদস্য উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, কাছেই আছে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর দামুন্যা গ্রাম। শুনে তো চমকিত। সেই ‘দামুন্যা করিল ধাম’! মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এই পঙক্তিকে বাদ দিয়ে হতেই পারে না। যেতে হয় সেই কবিতীর্থে।
বিদ্যাসাগরের ভিটে দেখতে বেরিয়েছিলাম তিনমূর্তি। সঙ্গী দীপু আর ইন্দ্র রাজি হল কবিকঙ্কণের গ্রামে যেতে। অবস্থান জেনে নিয়ে বাইক ছুটল। রাস্তাঘাট সুবিধের নয়। পেটের অবস্থাও খারাপ। দানাপানি বলতে ব্যাগের রেশনপত্র ভরসা। দুপুরের খাওয়া জুটবে না বলেই মনে হয়। বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করে, ভুল রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে এক সময়ে বাইক ঢুকল দামুন্যা গ্রামে। গ্রামে ঢোকার মুখে পূর্ত দফতরের বোর্ডে লেখা কবিকঙ্কণ বাজার। একটা সেতু পড়ল। সেতুর গায়েও লেখা, কবিকঙ্কণ সেতু। দেখে ভাল লাগছিল।

দামুন্যায় কবিকঙ্কণের নামে মঞ্চ।
কিন্তু ভাললাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আমাদের গন্তব্য ছিল কবিকঙ্কণ নামাঙ্কিত সংগ্রহশালায়। কিন্তু সেটি বন্ধ। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সংগ্রহশালার হালও খুব একটা সুবিধের নয়। যিনি কথা বলছিলেন তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ছিল, ‘‘এখন যা হাল চারিদিকে!’’ সংগ্রহশালাটি কবিকঙ্কণের বাস্তুভিটেয়। গায়ে লাগানো তিনটি ফলক। তা থেকে জানা যাচ্ছে, সংগ্রহশালার শিলান্যাস হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। রায়না-২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি উদয় সরকার এবং বিডিও অমিত সান্যাল শিলান্যাস করেন। সংগ্রহশালার দ্বারোদ্ঘাটন হয় ২০০৪ সালে। দ্বারোদ্ঘাটন করেন উদয় সরকারই। তখন তিনি জেলা পরিষদের সভাপতি হয়েছেন। দামুন্যা বর্ধমান জেলার, এখনকার প্রশাসনিক ভাগ হিসেবে পূর্ব বর্ধমান, রায়না থানার অন্তর্গত।
শিলান্যাস ও দ্বারোদ্ঘাটন ছাড়াও একটা ফলক আছে। তাতে সংগ্রহশালাকে কেন্দ্র করে কিছু কাজের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৩৯২ বঙ্গাব্দে ২৩ পৌষ একটা পদযাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। শুরু হয়েছিল চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র কালকেতু ব্যাধের জন্মগ্রাম মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার গোলাঘাট থেকে। শেষ হয় কাব্য রচয়িতা মুকুন্দরামের জন্মভিটে দামুন্যায়। শেষের দিন ৪ মাঘ। কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মুকুন্দরাম গবেষক প্রভাত মুখোপাধ্যায়, স্বপন বাগচী, শ্যামল সরকার, সুভাষ রায়, সন্তোষ ঘোষ ও শান্তা সরকার। ছিলেন অশোক কুণ্ডু ও দীপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যুক্ত ছিলেন বিল্বমঙ্গল ভট্টাচার্য ও চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়। এই বছরেই কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম সাংস্কৃতিক মেলা শুরু হয়েছিল। শুরু ৪ মাঘ। পদযাত্রার শেষ আর মেলার শুরু একই দিনে। অর্থাৎ মেলা শুরু উপলক্ষেই ছিল পদযাত্রা।

সংগ্রহশালার ফলক।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম কে ছিলেন? জানেন অনেকেই। তবুও একটু সূত্র ধরিয়ে দেওয়া। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ধারার শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় তাঁকে। বাংলার এক পালাবদলের সন্ধিক্ষণে তিনি দামুন্যা গ্রামে বাস করতেন। তখন পাঠান ও মোগল আমলের মারামারি চলছে। বিনয় ঘোষ ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’তে জানিয়েছেন, মোগল অভিযান ও পাঠানদের রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগে ‘গ্রামসমাজ ও বিদ্যাসমাজ’গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভাঙনও ধরেছিল। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে সামন্ত, জমিদার, জায়গিরদারের মতো স্থানীয় শাসকেরা অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল। দামুন্যায় অনেক পণ্ডিতে বাস ছিল। মুকুন্দরামের বংশেও অনেক পণ্ডিত জন্মেছিলেন। কিন্তু শাসকদের অত্যাচারে কবিকে গ্রাম ছাড়তে হল। কবি নিজেই তাঁর কাব্যে লিখেছেন, ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে তিনি গ্রাম ছাড়েন। স্ত্রী-পুত্র ও ভাইকে নিয়ে প্রথমে পৌঁছন ভেলিয়া গ্রামে। ডাকাতের হাতে পড়ে সব খোয়ালেন। কবিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যদু কুণ্ডু। পরে মুড়াই বা মুণ্ডেশ্বরী নদী পার করে তিনি ভেঙট্যা গ্রামে পৌঁছন। তার পর দ্বারকেশ্বর পার করে পাতুল গ্রামে। তার পর দামোদর পার করে গোচড্যা গ্রামে। এখানেই চণ্ডী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন।
চণ্ডীর আদেশে কবি পরিবার নিয়ে শিলাবতী পার করে আড়রা গ্রামে পৌঁছন। আড়রা বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার অন্তর্গত। আড়রাতে বসেই মুকুন্দরাম লিখেছিলেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। গ্রামে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন জমিদার বাঁকুড়া রায়। চণ্ডীর আদেশেই চণ্ডীমঙ্গল রচনা কবির। তবে বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথেরও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তাতে।
কেউ কেউ বলেন, মুকুন্দরাম বৃদ্ধ বয়সে দামুন্যা গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন যিনি তিনিও এই দাবি করেন। তবে বিনয় ঘোষ এই দাবিতে সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর অনুমান, কবিপুত্র শিবরাম হয়তো দামুন্যায় ফিরে এসেছিলেন।

মুকুন্দরাম সংগ্রহশালা।
সংগ্রহশালায় কী আছে দেখা সম্ভব নয়। ফিরে যেতে হবে। যে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তিনি জানালেন, কিছুটা দূরে কবিকঙ্কণের নামে একটা গ্রন্থাগার আছে। সেখানে কিছু বই মিলতে পারে। কিন্তু গ্রন্থাগারও ছিল বন্ধ।
কবিকঙ্কণের বাস্তুভিটে স্পর্শ করতে পেরেছি, এই সান্ত্বনা নিয়েই ফেরা।
কভারের ছবি— কবিকঙ্কণ সংগ্রহশালা
ছবি— দীপু ও ইন্দ্র
(সমাপ্ত)