ফারুক আবদুল্লাহ

কিছুটা এগোতেই দেখা গেল একটি গম্বুজওয়ালা রং করা স্থাপত্য। অঞ্জনদারই প্রথম চোখে পড়ে এই স্থাপত্যটি। গিয়ে দেখি সেটি আসলে মাজার বা দরগা। দরগার পিছন দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভাগীরথী নদী। দরগাটি বহু গাছপালা দিয়ে ঘেরা। এই তীব্র গরমেও সেখানে বেশ মনোরম পরিবেশ।
দেখলাম দরগার সামনে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরনো আমলের বেশ কিছু কালো রঙের বড় পাথর। সেই পাথরগুলোর একটিতে আমরা একটু জিরিয়ে নিতে বসলাম। এর মধ্যেই অঞ্জনদা লাঞ্চ করতে শুরু করলেন। তখন বেলা প্রায় ২টো পার হয়ে গিয়েছে। এই ফাঁকে আমি দরগার ভিতরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম। দরগায় ওঠার সামনে দিকের সিঁড়িগুলো দেখলাম কালো পাথরের তৈরি। সেই পাথরে আবার নকশা কাটা আছে যা দেখে মনে হল, এগুলো খুব সম্ভবত প্রাচীন মহীপাল নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকেই নেওয়া হয়েছে। এবার দরগার ভেতরে ঢুকলাম। রোদের তাপে মেঝেয় পা রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই। পা রাখতেই মনে হল, যেন কোনও গরম তাওয়াতে পা রেখেছি।

সেই সুন্দর দরগা।
দরগার ভেতর ঢোকার মূল ফটকের মাথায় সুন্দর কারুকার্য চোখে পড়ল। যা দেখে পাল আমলের ভাঙা স্থাপত্যের কোনও অংশ বলেই মনে হল। দেখলাম দরগার ভেতরে একাধিক কবর। কবরগুলোর মধ্যে মাঝের কবরটি বেশ বড়। খুব সম্ভবত সেটি কোনও পিরের কবর হবে। স্থানীয় মানুষেরা জানালেন, এই দরগাটি ফকির গিয়াসুদ্দিনের। এখানে সেই ফকিরের কবরের পাশে বাকি কবরগুলো নাকি পিরের নিকট আত্মীয়দের। তবে অনেকে দরগার বড় কবরটিকে আবার সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কবর বলেও দাবি করে থাকেন। যদিও সে সম্ভবনা অনেকটাই কম। দরগার ভেতরের মেঝে রোদের তাপে এতটাই গরম হয়ে উঠেছে যে সেখানে খালি পায়ে থাকা যাচ্ছে না। কোনও মতে একঝলক দেখে ছবি তুলে সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে অঞ্জনদার কাছে এসে সেই পাথরের উপরে বসে পড়লাম।

দরগার ভিতরের অংশ।
নদী থেকে হু হু করে গরম হওয়া তখন আমাদের গায়ে এসে লাগছে। এ ভাবেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। রোদের তাপ তখনও কমেনি। আমরা এবার সোজা ফাঁকা রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে দেখি রাস্তার দুই পাশে দিগন্ত বিস্তৃত জমি। সেখানে চাষবাস হচ্ছে এবং তার মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে বেশ কিছু পাকা বাড়িও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে একটি বিষয় বেশ অবাক করল। দেখি, আজও সেই কৃষিজমির মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র উচুঁ ঢিবি। এই ঢিবিগুলোই সাক্ষ্য দিচ্ছিল, মধ্যযুগে ভাগীরথী তীরের এই জনপদেই গয়সাবাদ নগরী গড়ে উঠেছিল।

দরগার পুরনো পাথরের সিঁড়ি ও নকশা।
এবার আরও কিছুটা পথ পার করে আমরা হুকারহাটে এসে পৌঁছেছি। এই এলাকাটিও তৎকালীন গয়সাবাদ নগরীর অংশ ছিল বলে জানা যায়। আজ অবশ্য স্বতন্ত্র গ্রাম। এই গ্রামটিও পুরনো নগরীর বহু স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে। হুকারহাট মোড় পার করে কয়েক পা এগোতেই একটি উচুঁ ঢিবি এবং সেখানে বেশ কয়েকটি পুরনো সমাধি রয়েছে। সমাধিগুলো ফুঁড়ে আবার বড় গাছও গজিয়েছে। সমাধিগুলো কার, কোন আমলের সে সম্পর্কে এলাকাবাসীদের কোনো ধারণা নেই ,তবে সমাধিগুলো সুলতানি আমলের বলেই মনে হল। একটি সমাধিতে দেখি, নকশা করা একটি কালো পাথরের অংশ। যা খুব সম্ভবত মহিপাল নগরের কোনো স্থাপত্যের গায়ে লাগানো ছিল।

হুকার হাট পার করে সেই উচু ঢিবির একটি সমাধিতে লাগানো পাথর।
প্রাচীন নগরীর স্মৃতিচিহ্নগুলি দেখে এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা। সেই মতো বাইকের মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে কিছুটা পথ এগিয়েই চোখে পড়ে রাস্তার একেবারে পাশে আরও একটি বিরাট ঢিবি যা প্রথমবার অদ্ভুত ভাবেই আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিলো। তবে এবার ঢিবিটি অঞ্জনদার চোখে পড়লে দাদা বাইক থামিয়ে দেয় সেখানে। আমরা বাইক থেকে নেমে এগিয়ে চলি ঢিবির দিকে। হুকারহাটের কাছে যে ঢিবির উপর কবর দেখেছিলাম এই ঢিবিটি তার চেয়েও অনেক উঁচু এবং সমগ্র ঢিবিটি নানান গাছগাছালিতে ঢাকা। দেখি, এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ঢিবির উপর থেকে তাঁর ছাগল নামাতে ব্যস্ত। আমি বুঝলাম ভদ্রলোক স্থানীয় মানুষ, তাঁকে ছাড়া যাবে না।

ঢিবির সমাধি।
আসলে একে এপ্রিল মাসের মাঝ দুপুরবেলা তাতে রমজান মাস। তাই রাস্তাঘাটে একেবারেই লোকজনের দেখা নেই যে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করব। এই বয়স্ক ভদ্রলোকের নাম আজিজুল রহমান। ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে ঢিবির সামনে এক আমগাছের ছায়ায় বসে গেলাম আলাপ জমাতে। তিনি আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কী করতে এসেছি এসব। আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তার পর একের পর এক আমার প্রশ্নবাণ চালিয়ে গেলাম। তিনি জানালেন, এমন ঢিবি এই একটা নয়। তিনি নাকি ছোটবেলায় মাঠের মধ্যে এর চেয়েও বড় বড় প্রচুর ঢিবি দেখেছেন। তিনি জানান যে, ২০০০ সালের বন্যায় বহু ঢিবি নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া অনেকে ঢিবি কেটে ইট ভাটার মাটি সরবরাহ করেছে। আবার অনেকে ঢিবি কেটে চাষের জমি তৈরি করেছে। তবুও মাঠের মধ্যে বেশ কিছু ঢিবি রয়ে গিয়েছে।

আজিজুল সাহেব।
তিনি আরও জানান, ঢিবি কাটতে গিয়ে স্থানীয় অনেক ভাগ্যবান মানুষ নাকি সোনাদানাও পেয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাটির পাত্রের ভাঙা অংশই বেশি উঠে আসে মাটি কাটতে গিয়ে। কর্ণসুবর্ণের ক্ষেত্রেও এমন বহু গল্প আমি শুনেছিলাম। আজিজুল সাহেব রাস্তার পাশের এই বড়ো ঢিবিটি দেখিয়ে জানান, এই ঢিবিটিকে স্থানীয় মানুষ খুব সমীহ করে চলে। তারা ঢিবির মাটি কাটে না। এমনকি ঢিবির গায়ে জন্মানো গাছের ডালপালাও নাকি ভাঙে না। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, এই ঢিবিটি নাকি কোনও এক সাধু বাবার। এখানে এখন বহু মানুষ মানতও করে।

মাঠের মধ্যে ঢিবি।
গাছতলায় আমাদের আড্ডা জমে গিয়েছে। ওদিকে অঞ্জনদাকে দেখছি, ওই দুর্গম ঢিবিতে ওঠার চেষ্টা করছেন। দাদাকে দেখে আমারও ঢিবিতে ওঠার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু জমে ওঠা আড্ডা বাদ দিয়ে সেখানে যেতেও পারছিলাম না। আমি প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ভদ্রলোকের কাছে জেনে নিয়ে ঢিবিতে উঠতে শুরু করলাম। যদিও ততক্ষণে অঞ্জনদা নেমে এসেছেন ঢিবি থেকে। তবে আমাকে সঙ্গ দিতে দাদা পুনরায় ঢিবির উপরে এলেন। আমাদের ঢিবিতে উঠতে দেখি আজিজুল সাহেবও উপরে এসে হাজির হয়েছেন। চূড়ায় উঠে দেখি ঢিবির ঠিক পিছনেই নদী বয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারের উচু ঢিবি।
ঢিবিটি আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছে। অঞ্জনদা বলে উঠলেন, তাঁর উপলব্ধি হচ্ছে ঢিবির ভেতরে ইটের কাঠামো রয়েছে। আমারও তাই মনে হল ঢিবির মাটিতে চাপ দিয়ে। তা ছাড়া আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, ঢিবির গায়ের মাটিতে অসংখ্য ইটের টুকরো মিশে রয়েছে। আজিজুল সাহেব বললেন, ২০০০ সালের বন্যায় যখন চারিদিক ডুবে গিয়েছিল তখন এলাকার বেশ কিছু অসহায় মানুষ নাকি এই ঢিবিতেই আশ্রয় নিয়েছিল। ঢিবির অবস্থান দেখে মনে হচ্ছিল ঢিবির স্থানে হয়তো সুলতানি আমলের কোনও প্রাসাদ বা কোনও সরকারি দফতর ছিল।
ইতিমধ্যেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে একদা সুলতানি আমলের নগরী গয়সাবাদে। আজিজুল সাহেবকে বিদায় জানিয়ে আমরাও আবার বেরিয়ে পড়ি। পিছনে তখন পড়ে থাকে পুরনো ঢিবি, আজিজুল সাহেব আর পুরনো নগরীর অজস্র স্মৃতিচিহ্ন।
কভারের ছবি— হুকারহাট পার করে রাস্তার পাশের উঁচু ঢিবি
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)